পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S88 রবীন্দ্র-রচনাবলী আত্মসম্মান লাভ করিব না এবং পরের নিকট সম্মান প্রাপ্ত হইব না। আমরা নিজের মূল্য নিজে অত্যন্ত কমাইয়া দিয়াছি । ক্ষিতি কহিল— সে মূল্য বাড়াইতে হইলে এ দিকে বেতনবৃদ্ধি করিতে হয়, সেটা প্ৰভুদের হাতে । দীপ্তি কহিল— বেতনবৃদ্ধি নহে, চেতনবৃদ্ধির আবশ্যক। আমাদের দেশের ধনীরাও যে অশোভন ভাবে থাকে সেটা কেবল জড়তা এবং মুঢ়তা -বশত, অর্থের অভাবে নহে। যাহার টাকা আছে সে মনে করে জুড়িগাড়ি না হইলে তাহার ঐশ্বৰ্য প্রমাণ হয় না, কিন্তু তাহার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলে দেখা যায় যে, তাহা ভদ্রলোকের গোশালারও অযোগ্য । অহংকারের পক্ষে যে আয়োজন আবশ্যক তাহার প্রতি আমাদের টাকা কুলায় না। আমাদের মেয়েরা এ কথা মনেও করে না যে, সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য যতটুকু অলংকার আবশ্যক তাহার অধিক পরিয়া ধনগৰ্ব্ব প্ৰকাশ করিতে যাওয়া ইত্যরজন্যোচিত অভদ্রতাএবং সেই অহংকার তৃপ্তির জন্য টাকার অভাব হয় না, কিন্তু প্রাঙ্গণপূর্ণ আবর্জনা এবং শয়নগৃহভিত্তির আমাদের দেশে যথার্থ ভদ্রতার আদর্শ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নাই । স্রোতস্বিনী কহিল— তাহার প্রধান কারণ, আমরা অলস। টাকা থাকিলেই বড়োমানুষি করা যায়, টাকা না থাকিলেও ধার করিয়া নবাবি করা চলে, কিন্তু ভদ্র হইতে গেলে আলস্য-অবহেলা বিসর্জন করিতে হয়, সর্বদা আপনাকে উন্নত সামাজিক আদর্শের উপযোগী করিয়া প্ৰস্তুত রাখিতে হয়, নিয়ম স্বীকার করিয়া আত্মবিসর্জন করিতে হয় । ক্ষিতি কহিল- কিন্তু আমরা মনে করি আমরা স্বভাবের শিশু, অতএব অত্যন্ত সরল । ধুলায় কাদায় নগ্নতায়, সর্বপ্রকার নিয়মহীনতায় আমাদের কোনো লজ্জা নাই- আমাদের সকলই অকৃত্রিম এবং সকলই আধ্যাত্মিক । א סס\ Q6 Sקבc অপূর্ব রামায়ণ বাড়িতে একটা শুভকাৰ্য ছিল, তাই বিকালের দিকে অদূরবতী মঞ্চের উপর হইতে বারোয়া রাগিণীতে মুক্ত বাজিতেছিল। ব্যোম অনেকক্ষণ মুদ্রিতচক্ষে থাকিয়া হঠাৎ চক্ষু খুলিয়া বলিতে আরম্ভ আমাদের এই-সকল দেশীয় রাগিণীর মধ্যে একটা পরিব্যাপ্ত মৃত্যুশোকের ভাব আছে ; সুরগুলি কঁদিয়া কাদিয়া বলিতেছে, সংসারে কিছুই স্থায়ী হয় না। সংসারে সকলই অস্থায়ী, এ কথাটা সংসারীর পক্ষে নূতন নহে, প্রিয়ও নহে, ইহা একটা অটল কঠিন সত্য ; কিন্তু তবু এটা বাঁশির মুখে শুনিতে এত ভালো লাগিতেছে কেন ? কারণ, বাঁশিতে জগতের এই সর্বাপেক্ষা সুকঠোর সত্যটাকে সর্বাপেক্ষা সুমধুর করিয়া বলিতেছে- মনে হইতেছে, মৃত্যুটা এই রাগিণীর মতো সকরুণ বটে, কিন্তু এই রাগিণীর মতোই সুন্দর। জগৎসংসারের বক্ষের উপরে সর্বাপেক্ষা গুরুতম যে জগদ্দল পাথরটা চাপিয়া আছে এই গানের সুরে সেইটাকে কী-এক মন্ত্রবলে লঘু করিয়া দিতেছে। একজনের হৃদয়কুহর হইতে উচ্ছসিত হইয়া উঠিলে যে বেদনা চীৎকার হইয়া বাজিয়া উঠিত, ক্ৰন্দন হইয়া ফাটিয়া পড়িত, বঁাশি তাহাই সমস্ত জগতের মুখ হইতে ধ্বনিত করিয়া তুলিয়া এমন অগাধকরুণাপূর্ণ অথচ অনন্তসত্ত্বনাময় রাগিণীর সৃষ্টি করিতেছে। − দীপ্তি এবং স্রোতস্বিনী আতিথ্যের কােজ সারিয়া সবেমাত্ৰ আসিয়া বসিয়াছিল, এমন সময় আজিকার এই মঙ্গলকার্যের দিনে ব্যোমের মুখে মৃত্যুসম্বন্ধীয় আলোচনায় অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়া গেল । ব্যোম তাহাদের বিরক্তি না বুঝিতে পারিয়া অবিচলিত অম্লানমুখে বলিয়া যাইতে লাগিল। নহবতটা বেশ লাগিতেছিল, আমরা আর সেদিন বড়ো তর্ক করিলাম না।