পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ぬ8ど রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্যক্ত করিয়া দিয়াছে, তাহাকে এক অনন্ত বাসরশয্যায় এক পরামরহস্যের সহিত পরিণয়পাশে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সেই রুদ্ধদ্বার বাসরগাহের গোপন বাতায়নপথ হইতে অনন্ত সৌন্দর্যের সৌগন্ধ এবং ংগীত আসিয়া আমাদিগকে স্পর্শ করিতেছে, তেমনি সাহিত্যািরস এবং কলারস আমাদের জড়ভারাগ্রস্ত বিক্ষিপ্ত প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে প্রত্যক্ষের সহিত অপ্রত্যক্ষের, অনিত্যের সহিত নিত্যের, তুচ্ছের সহিত সুন্দরের, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র সুখদুঃখের সহিত বিশ্বব্যাপী বৃহৎ রাগিণীর যোগসাধন করিয়া তুলিতেছে। আমাদের সমস্ত প্রেমকে পৃথিবী হইতে প্রত্যাহরণ করিয়া মৃত্যুর পারে পাঠাইয়া দিব, না, এই পৃথিবীতেই রাখিব, ইহা লইয়াই তর্ক ! আমাদের প্রাচীন বৈরাগ্যধৰ্ম বলিতেছে, পরকালের মধ্যেই প্রকৃত প্রেমের স্থান ; নবীন সাহিত্য এবং ললিতকলা বলিতেছে, ইহলোকেই আমরা তাহার স্থান দেখাইয়া দিতেছি । ক্ষিতি কহিল— এই প্রসঙ্গে আমি এক অপূর্ব রামায়ণ-কথা বলিয়া সভা ভঙ্গ করিতে ইচ্ছা করি । রাজা রামচন্দ্র-- অর্থাৎ মানুয- প্ৰেম-নামক সীতাকে নানা রক্ষসের হাত হইতে রক্ষা করিয়া আনিয়া নিজের অযোধ্যাপুরীতে পরমসুখে বাস করিতেছিলেন । এমন সময় কতকগুলি ধৰ্মশাস্ত্ৰ দল বাধিয়া এই প্রেমের নামে কলঙ্ক রটনা করিয়া দিল । বলিল, উনি অনিত্য পদার্থের সহিত একত্র বাস করিয়াছেন, উহাকে পরিত্যাগ করিতে হইবে । বাস্তবিক অনিত্যের ঘরে রুদ্ধ থাকিয়াও এই দেবাংশজাত রাজকুমারীকে যে কলঙ্ক স্পর্শ করিতে পারে নাই, সে কথা এখন কে প্রমাণ করিবে ? এক, অগ্নিপরীক্ষা আছে, সে তো দেখা হইয়াছে- অগ্নিতে ইহাকে নষ্ট না করিয়া আরো উজজুল করিয়া দিয়াছে । তবু শাস্ত্রের কানাকানিতে অবশেষে এই রাজা প্রেমকে একদিন মৃত্য-তমসার তীরে নির্বাসিত করিয়া দিলেন ! ইতিমধ্যে মহাকবি এবং তাহার শিষ্যবৃন্দের আশ্রয়ে থাকিয়া এই অনাথিনী কুশ এবং লব, কাব্য এবং ললিতকলা নামক যুগল-সন্তান, প্রসব করিয়াছেন । সেই দুটি শিশুই কবির কাছে রাগিণী শিক্ষা করিয়া রাজসভায় আজ তাহদের পরিত্যক্ত জননীর যশোগান করিতে আসিয়াছে । এই নবীন গায়কের গানে বিরহী রাজার চিত্ত চঞ্চল এবং তাহার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিয়াছে ৷ এখনো উত্তরকাণ্ড সম্পূৰ্ণ শেষ হয় নাই। এখনো দেখিবার আছে— জয় হয় ত্যাগপ্রচারক প্রবীণ বৈরাগ্যধর্মের, না, প্ৰেমমঙ্গল-গায়ক দুটি অমর শিশুর । उग्रक्षा ७७०२ বৈজ্ঞানিক কৌতুহল বিজ্ঞানের আদিম উৎপত্তি এবং চরম লক্ষ্য লইয়া ব্যোম এবং ক্ষিতির মধ্যে মহা তর্ক বাধিয়া গিয়াছিল। তদুপলক্ষে ব্যোম কহিল— যদিও আমাদের কৌতুহল বৃত্তি হইতেই বিজ্ঞানের উৎপত্তি, তথাপি, আমার বিশ্বাস, আমাদের কৌতুহলটা ঠিক বিজ্ঞানের তল্লাশ করিতে বাহির হয় নাই ; বরঞ্চ তাহার আকাঙক্ষাটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক । সে খুঁজিতে যায় পরশপাথর, বাহির হইয়া পড়ে একটা প্রাচীন জীবের জীর্ণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ; সে চায় আলাদিনের আশ্চর্য প্ৰদীপ, পায় দেশালাইয়ের বাক্স ; আলকিমিটাই তাহার মনােগত উদ্দেশ্য, কেমিষ্ট্র তাহার অপ্রার্থিত সিদ্ধি ; অ্যােষ্ট্রলজির জন্য সে আকাশ ঘিরিয়া জাল ফেলে, কিন্তু হাতে উঠিয়া আসে অ্যাষ্ট্রনমি । সে নিয়ম খোজে না, সে কার্যকরণশঙ্খলের নব নব অঙ্গুরী। গণনা করিতে চায় না ; সে খোজে নিয়মের বিচ্ছেদ ; সে মনে করে কোন সময়ে এক জায়গায় আসিয়া হঠাৎ দেখিতে পাইবে সেখানে কার্যকারণের অনন্ত পুনরুক্তি নাই । সে চায় অভূতপূর্ব নূতনত্ব— কিন্তু বৃদ্ধ বিজ্ঞান নিঃশব্দে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়া তাহার সমস্ত নূতনকে পুরাতন করিয়া দেয়, তাহার ইন্দ্ৰধনুকে পর্যকলা-বিছুরিত বর্ণমালার পরিবর্ধিত সংস্করণ এবং পৃথিবীর গতিকে পক্কতালফলপতনের সমশ্রেণীয় বলিয়া প্রমাণ করে। যে নিয়ম আমাদের ধূলিকণার মধ্যে, অনন্ত আকাশ ও অনন্ত কালের সর্বত্রই সেই এক নিয়ম