পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

እS8b” রবীন্দ্র-রচনাবলী অত্যন্ত প্ৰবল ; ইচ্ছার সহিত যে দান আমরা প্ৰাপ্ত হই সে দান আমাদের কাছে অধিকতর প্রিয় ; সেবা যতই পাই তাহার সহিত ইচ্ছার যোগ না থাকিলে তাহা আমাদের নিকট রুচিকর বোধ হয় না । সেইজন্য, যখন জানিতাম যে, ইন্দ্র আমাদিগকে বৃষ্টি দিতেছেন, মরুৎ আমাদিগকে বায়ু জোগাইতেছেন, অগ্নি আমাদিগকে দীপ্তি দান করিতেছেন, তখন সেই জ্ঞানের মধ্যে আমাদের একটা আন্তরিক তৃপ্তি ছিল। এখন জানি, রৌদ্রবৃষ্টিবায়ুর মধ্যে ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই, তাহারা যোগ্য-অযোগ্য প্ৰিয়-অপ্রিয় বিচার না করিয়া নির্বিকারে যথানিয়মে কাজ করে ; আকাশে জলীয় অণু শীতলবায়ুসংযোগে সংহত হইলেই সাধুর পবিত্ৰমস্তকে বর্ষিত হইয়া সদি উৎপাদন করিবে এবং অসাধুর কুম্মাণ্ডমঞ্চে জলসিঞ্চন করিতে কুষ্ঠিত হইবে না— বিজ্ঞান আলোচনা করিতে করিতে ইহা আমাদের ক্রমে একরূপ সহ্য হইয়া আসে, কিন্তু বস্তুত ইহা আমাদের ভালোই লাগে না । আমি কহিলাম— পূর্বে আমরা যেখানে স্বাধীন ইচ্ছার কর্তৃত্ব অনুমান করিয়াছিলাম, এখন সেখানে নিয়মের অন্ধ শাসন দেখিতে পাই, সেইজন্য বিজ্ঞান আলোচনা করিলে জগৎকে নিরানন্দ ইচ্ছাসম্পর্কবিহীন বলিয়া মনে হয় । কিন্তু ইচ্ছা এবং আনন্দ যতক্ষণ আমার অন্তরে আছে, ততক্ষণ জগতের অন্তরে তাহাকে অনুভব করিতেই হইবে— পূর্বে তাহাকে যেখানে কল্পনা করিয়াছিলাম সেখানে না হউক, তাহার অন্তরতর অন্তরতম স্থানে তাহাকে প্রতিষ্ঠিত না জানিলে আমাদের অন্তরতম প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার করা হয় । আমার মধ্যে সমস্ত বিশ্বনিয়মের যে-একটি ব্যতিক্রম আছে, জগতে কোথাও তাহার একটা মূল আদর্শ নাই, ইহা আমাদের অন্তরাত্মা স্বীকার করিতে চাহে না । এইজন্য আমাদের ইচ্ছা একটা বিশ্ব-ইচ্ছার, আমাদের প্রেম একটা বিশ্বপ্রেমের নিগুঢ় অপেক্ষা না রাখিয়া বাচিতে 26 भां । সমীর কহিল— জড়প্রকৃতির সর্বত্রই নিয়মের প্রাচীর চীনদেশের প্রাচীরের অপেক্ষা দৃঢ়, প্রশস্ত ও অভ্ৰভেদী ; হঠাৎ মানবপ্রকৃতির মধ্যে একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র বাহির হইয়াছে, সেইখানে চক্ষু দিয়াই আমরা এক আশ্চর্য আবিষ্কার করিয়াছি, দেখিয়াছি প্রাচীরের পরপারে এক অনন্ত অনিয়ম রহিয়াছে ; এই ছিদ্রপথে তাহার সহিত আমাদের যোগ ; সেইখান হইতেই সমস্ত সৌন্দর্য স্বাধীনতা প্ৰেম আনন্দ প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে । সেইজন্য এই সৌন্দর্য ও প্ৰেমকে কোনো বিজ্ঞানের নিয়মে বাধিতে °व्नि क् | এমন সময়ে স্রোতস্বিনী গৃহে প্ৰবেশ করিয়া সমীরকে কহিল— সেদিন দীপ্তির পিয়ানো বাজাইবার স্বরলিপি-বইখানা তোমরা এত করিয়া খুঁজিতেছিলে, সেটার কী দশা হইয়াছে জান ? সমীর কহিল- না । স্রোতস্বিনী কহিল- রাত্রে ইদুরে তাহা কুটি কুটি করিয়া কাটিয়া পিয়ানোর তারের মধ্যে ছড়াইয়া রাখিয়াছে। এরূপ অনাবশ্যক ক্ষতি করিবার তো কোনো উদ্দেশ্য খুঁজিয়া পাওয়া যায় না । সমীর কহিল— উক্ত ইন্দুরটি বোধ করি ইন্দুরবংশে একটি বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক ; বিস্তর গবেষণায় সে বাজনার বহির সহিত বাজনার তারের একটা সম্বন্ধ অনুমান করিতে পারিয়াছে। এখন। সমস্ত রাত ধরিয়া পরীক্ষা চালাইতেছে। বিচিত্র ঐকতানপূর্ণ সংগীতের আশ্চর্য রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিতেছে । তীক্ষ্ণ দস্তাগ্রভাগ-দ্বারা বাজনার বহির ক্রমাগত বিশ্লেষণ করিতেছে, পিয়ানোর তারের সহিত তাহাকে নানাভাবে একত্র করিয়া দেখিতেছে । এখন বাজনার বই কাটিতে শুরু করিয়াছে, ক্ৰমে বাজনার তার কাটিবে, কাঠ কাটিবে, বাজনােটাকে শতছিন্দ্ৰ করিয়া সেই ছিদ্রপথে আপন সূক্ষ্ম নাসিকা ও চঞ্চল কৌতুহল প্রবেশ করাইয়া দিবে।— মাঝে হইতে সংগীতও ততই উত্তরোত্তর সুদূরপরাহত হইবে । আমার মনে এই তর্ক উদয় হইতেছে যে ইন্দুরকুলতিলক যে উপায় অবলম্বন করিয়াছে তাহাতে তার এবং কাগজের উপাদান সম্বন্ধে নূতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইতে পারে, কিন্তু উক্ত কাগজের সহিত উক্ত তারের যথার্থ যে সম্বন্ধ তাহা কি শতসহস্ৰ বৎসরেও বাহির হইবে । অবশেষে কি সংশয়পরায়ণ নব্য ইন্দুরদিগের মনে এইরূপ একটা বিতর্ক উপস্থিত হইবে না যে, কাগজ কেবল কাগজ মাত্র, এবং তার কেবল তার— কোনো জ্ঞানবান জীব -কর্তৃক উহাদের মধ্যে যে একটা আনন্দজনক