পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

. NSON) 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আচার্য। প্ৰসন্ন হয়েছেন ? তা হবে । হয়তো প্ৰসন্নই হয়েছেন । কিন্তু কেমন করে জানিব ? উপাচার্য। নইলে তিনি আসবেন কেন ? আচার্য। এক-এক সময়ে মনে ভয় হয় যে, হয়তো অপরাধের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে বলেই তিনি । আসছেন । উপাচার্য। না, আচার্যদেব, এমন কথা বলবেন না । আমরা কঠোর নিয়ম সমস্তই নিঃশেষে পালন করেছি- কোনো ক্ৰটি ঘটে নি । আচার্য। কঠোর নিয়ম ? হা, সমস্তই পালিত হয়েছে। ܝ উপাচার্য। বজশুদ্ধিব্ৰত আমাদের আয়তনে এইবার নিয়ে ঠিক সাতত্তর বার পূর্ণ হয়েছে। আর কোনো আয়তনে এ কি সম্ভবপর হয় । আচাৰ্য । না, আর কোথাও হতে পারে না । উপাচার্য। কিন্তু তবু আপনার মনে এমন দ্বিধা হচ্ছে কেন ? আচার্য। দ্বিধা ? তা দ্বিধা হচ্ছে সে কথা স্বীকার করি। (কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া) দেখো সূতসোম, অনেক দিন থেকে মনের মধ্যে বেদনা জেগে উঠছে, কাউকে বলতে পারছি নে । আমি এই আয়তনের আচার্য ; আমার মনকে যখন কোনো সংশয় বিদ্ধ করতে থাকে তখন একলা চুপ করে বহন করতে হয় । এতদিন তাই বহন করে এসেছি। কিন্তু যেদিন পত্র পেয়েছি গুরু আসছেন সেইদিন থেকে মনকে আর যেন চুপ করিয়ে রাখতে পারছি নে। সে কেবলই আমাদের প্রতিদিনের সকল কাজেই বলে বলে। উঠছে—বৃথা, বৃথা, সমস্তই বৃথা । উপাচার্য । আচাৰ্যদেব, বলেন কী । বৃথা, সমস্তই বৃথা ? আচার্য। সূতসোম, আমরা এখানে কতদিন হল এসেছি মনে পড়ে কি ? কত বছর হবে ? উপাচার্য। সময় ঠিক করে বলা বড়ো কঠিন । এখানে মনের পক্ষে প্রাচীন হয়ে উঠতে বয়সের দরকার হয় না। আমার তো মনে হয় আমি জন্মের বহু পূর্ব হতেই এখানে স্থির হয়ে বসে আছি। আচার্য। দেখো সূতসোম, প্রথম যখন এখানে সাধনা আরম্ভ করেছিলুম তখন নবীন বয়স, তখন আশা ছিল সাধনার শেষে একটা-কিছু পাওয়া যাবে । সেইজন্যে সাধনা যতই কঠিন হচ্ছিল উৎসাহ আরো বেড়ে উঠছিল। তার পরে সেই সাধনার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একেবারেই ভুলে বসেছিলুম যে সিদ্ধি বলে কিছু-একটা আছে । আজ গুরু আসবেন শুনে হঠাৎ মনটা থমকে দাঁড়াল— আজ নিজেকে জিজ্ঞাসা করলুম, ওরে পণ্ডিত, তোর সব শাস্ত্ৰই তো পড়া হল, সব ব্ৰতই তো পালন করলি, এখন বল মুখ, কী পেয়েছিস । কিছু না কিছু না, সূতসোম। আজ দেখছি— এই অতিদীর্ঘকালের সাধনা কেবল মাির্কই আপনি প্রক্ষিণ করেছে- কেবল প্রতিদিনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি কাশীকৃত হয়ে জন্ম উপাচার্য। বোলো না, বোলো না, এমন কথা বোলো না । আচাৰ্যদেব, আজ কেন হঠাৎ তোমার মন এত উদভ্ৰান্ত হল ! আচার্য। সূতসোম, তোমার মনে কি তুমি শান্তি পেয়েছ ? : উপাচার্য। আমার তো এক মুহুর্তের জন্যে অশান্তি নেই। আচার্য। অশান্তি নেই ? উপাচার্য। কিছুমাত্র না । আমার অহােরাত্র একেবারে নিয়মে বাঁধা । সে 'হাজার বছরের বঁাধন । ক্রমেই সে পাথরের মতো বজের মতো শক্ত হয়ে জমে গেছে। এক মুহুর্তের জন্যেও কিছুই ভাবতে হয় না । এর চেয়ে আর শাস্তি কী হতে পারে ? আচার্য। না না, তবে আমি ভুল করছিলুম সূতসোম, ভুল করছিলুম। যা আছে। এই ঠিক, এইই ঠিক । যে করেই হােক এর মধ্যে শান্তি পেতেই হবে । উপাচার্য। সেইজন্যেই তো অচলায়তন ছেড়ে আমাদের কোথাও বেরোনো নিষেধ। তাতে যে মনের বিক্ষেপ ঘটে।- শান্তি চলে যায় ।