পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন 8VS জখম, পাঠিয়ে দিল তাকে মেরামত করতে । শৰ্মিলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। বাষ্পাকুলকণ্ঠে বললে, “গাড়ি তুমি নিজে হাঁকাতে পারবে না।” শশাঙ্ক হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললে, “পরের হাতের আপদও একই জাতের দুশমন।” একদিন কোন মেরামতের কাজ তদন্ত করতে গিয়ে জুতো ফুড়ে পায়ে ফুটল ভাঙা প্যাকবাক্সর পেরেক, হাসপাতালে গিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ধনুষ্টংকারের টিকে নিলে, সেদিন কান্নাকাটি করলে শর্মিলা ; বললে, “কিছুদিন থাকো শুয়ে ।” শশাঙ্ক অত্যন্ত সংক্ষেপে বললে, “কাজ ।” এর চেয়ে বাক্য আর সংক্ষেপ করা যায় না । শৰ্মিলা বললে, “কিন্তু”— এবার বিনা বাক্যেই ব্যান্ডেজসুদ্ধ চলে গেল কাজে । , জোর খাটাতে আর সাহস হয় না। আপন ক্ষেত্রে পুরুষের জোর দেখা দিয়েছে। যুক্তিতর্ক-কাকুতিমিনতির বাইরে একটিমাত্র কথা— কাজ আছে। শৰ্মিলা অকারণে উদবিগ্ন হয়ে বসে থাকে। দেরি হলেই ভাবে মোটরে বিপদ ঘটেছে। রোদন্দুর লাগিয়ে স্বামীর মুখ যখন দেখে রক্তবর্ণ, মনে করে নিশ্চয় ইনফ্লুয়েঞ্জা । ভয়ে ভয়ে আভাস দেয় ডাক্তারের- স্বামীর ভাবখানা দেখে ঐখানেই থেমে যায়। মন খুলে উদবেগ প্রকাশ করতেও আজকাল ভরসা হয় না। শশাঙ্ক দেখতে দেখতে রোদো-পোড়া খট্রখটে হয়ে উঠেছে। খাটাে আঁট কাপড়, খাটাে আঁট অবকাশ, চালচলন দ্রুত, কথাবার্তা স্মৃলিঙ্গের মতো সংক্ষিপ্ত । শৰ্মিলার সেবা এই দ্রুতলয়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে চেষ্টা করে। স্টোভের কাছে কিছু খাবার সর্বদাই গরম রাখতে হয়, কখন স্বামী হঠাৎ অসময়ে বলে বসে, “চেললুম, ফিরতে দেরি হবে।” মোটরগাড়িতে গোছানো থাকে সোডাওয়াটার এবং ছোটাে টিনের বাক্সে শুকনোজাতের খাবার। একটা ওডিকেলনের শিশি বিশেষ দৃষ্টিগোচররাপেই রাখা থাকে, যদি মাথা ধরে । গাড়ি ফিরে এলে পরীক্ষা করে দেখে কোনোটাই ব্যবহার করা হয় নি। মন খারাপ হয়ে যায়। সাফ কাপড় শোবার ঘরে প্রত্যহই সুপ্রকাশ্যভাবে ভঁাজ করা, তৎসত্ত্বেও অন্তত সপ্তাহে চার দিন কাপড় ছাড়বার অবকাশ থাকে না । ঘরকন্নার পরামর্শ খুবই খাটাে করে আনতে । হয়েছে, জরুরি টেলিগ্রামের ঠোকর-মারা ভাষার ধরনে, সেও চলতে চলতে পিছু ডাকতে ডাকতে, বলতে বলতে ‘ওগো শুনে যাও কথাটা ।” ওদের ব্যাবসার মধ্যে শর্মিলার যে একটুখানি যোগ ছিল তাও গেল কেটে, ওর টাকাটা এসেছে সুদে আসলে শোধ হয়ে । সুদও দিয়েছে মাপজোখ-করা হিসেবে, দস্তুরমত রসিদ নিয়ে । শৰ্মিলা বলে, “বাস রে, ভালোবাসাতেও পুরুষ আপনাকে সবটা মেলাতে পারে না । একটা জায়গা ফাঁকা রাখে, সেইখানটাতে ওদের পৌরুষের অভিমান ।” লাভের টাকা থেকে শশাঙ্ক মনের মতাে বাড়ি খাড়া করেছে ভবানীপুরে। ওর শখের জিনিস। স্বাস্থ্য আরাম শৃঙ্খলার নতুন নতুন প্ল্যান আসছে মাথায় । শৰ্মিলাকে আশ্চর্য করবার চেষ্টা । শৰ্মিলাও বিধিমত আশ্চর্য হতে ক্ৰটি করে না। এঞ্জিনিয়ার একটা কাপড়-কাচা কলের পত্তন করেছে, শর্মিলা । সেটাকে ঘুরে ফিরে দেখে খুব তারিফ করলে। মনে মনে বললে, “কাপড় আজও যেমন ধোবার বাড়ি যাচ্ছে কালও তেমনি যাবে। ময়লা কাপড়ের গর্দভবাহনকে বুঝে নিয়েছি, তার বিজ্ঞানবাহনকে বুঝি নে৷ ” আলুর খোসা ছাড়াবার যন্ত্রটা দেখে তাক লেগে গেল, বললে, “আলুর দম তৈরি করবার । বারো-আনা দুঃখ যাবে কেটে ।” পরে শোনা গেছে সেটা ফুটাে ডেকচি ভাঙা কাৎলি প্রভৃতির সঙ্গে এক বাড়িটা যখন শেষ হয়ে গেল তখন এই স্থাবর পদার্থটার প্রতি শৰ্মিলার রুদ্ধ মেহের উদ্যম ছাড়া পেলে । সুবিধা এই যে, ইটকাঠের দেহটাতে ধৈৰ্য অটল। গোছানো-গাছানো সাজানো-গোজানোর মহােদ্যমে দুই-দুইজন বেহারিা হাঁপিয়ে উঠল, একজন দিয়ে গেল। জবাব । ঘরগুলোর গৃহসজ্জা চলছে শশাঙ্ককে লক্ষ্য করে। বৈঠকখানাঘরে সে আজকাল প্রায়ই বসে না, তবু তারই ক্লান্ত মেরুদণ্ডের উদ্দেশে কুশন নিবেদন করা হচ্ছে নানা ফ্যাশনের ; ফুলদানি একটা-আধটা নয়, টিপায়ে টেবিলে ঝালরওআলা। ফুলকাটা আবরণ। শোবার ঘরে দিনের বেলায় শশাঙ্কর সমাগম আজকাল বন্ধ, কেননা তাঁর আধুনিক পঞ্জিকায় রবিবারটা সোমবারেরই যমজ ভাই। অন্য ছুটিতে কাজ যখন বন্ধ তখনো