পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

দুই (Kiss 8VOVO) নীরদ বাঙ্কে-জমা টাকায় সওয়ার হয়ে এ পরিবারের সমৃদ্ধি যে সময়টাতে ছুটে চলেছে ছয় সংখ্যার অঙ্কের দিকে সেই সময়ে শৰ্মিলাকে ধরল। দুর্বোধি কোন-এক রোগে, ওঠবার শক্তি রইল না । এ নিয়ে কেন যে দুর্ভাবনা সে কথাটা বিবৃত করা দরকার। রাজারামবাবু ছিলেন। শৰ্মিলার বাপ । বরিশাল অঞ্চলে এবং গঙ্গার মোহনার কাছে তার অনেকগুলি মন্ত জমিদারি। তা ছাড়া জাহাজ-তৈরির ব্যবসায়ে তীর শেয়ার আছে শালিমারের ঘাটে ৷ তীর জন্ম সেকালের সীমানায়, একালের শুরুতে । কুস্তিতে শিকারে লাঠিখেলায় ছিলেন ওস্তাদ ৷ পাখোয়াজে নাম ছিল প্রসিদ্ধ। মার্চেন্ট অফ ভেনিস, জুলিয়াস সিজার, হ্যামলেট থেকে দু-চার পাতা মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। মেকলের ইংরেজি ছিল তীর আদর্শ, বার্কের বাগিতায় ছিলেন মুগ্ধ, বাংলাভাষায় তার শ্রদ্ধার সীমা ছিল মেঘনাদবধকাব্য পর্যন্ত । মধ্যবয়সে মদ এবং নিষিদ্ধ ভোজ্যকে আধুনিক চিত্তোৎকর্ষের আবশ্যক অঙ্গ বলে জানতেন, শেষবয়সে ছেড়ে দিয়েছেন । সযত্ন ছিল তার পরিচ্ছদ, সুন্দর গম্ভীর ছিল তীর মুখশ্ৰী, দীর্ঘ বলিষ্ঠ ছিল তার দেহ, মেজাজ ছিল মজলিশি, কোনো প্ৰাথী তীকে ধরে পড়লে ‘না’ বলতে জানতেন না। নিষ্ঠা ছিল না পূজাৰ্চনায়, অথচ সেটা সমারোহে প্রচলিত ছিল র্তার বাড়িতে। সমারোহ দ্বারা কৌলিক মর্যাদা প্রকাশ পেত, পূজাটা ছিল মেয়েদের এবং অন্যদের জন্যে । ইচ্ছে করলে অনায়াসেই রাজা উপাধি পেতে পারতেন ; ঔদাস্যের কারণ জিজ্ঞেস করলে রাজারাম হেসে বলতেন, পিতৃদত্ত রাজোপাধি ভোগ করছেন, তার উপরে অন্য উপাধিকে আসন দিলে সম্মান খর্ব হবে। গবর্মেন্টু হাউসে তার ছিল বিশেষ দেউড়িতে সম্মানিত প্রবেশিকা । কর্তৃপক্ষীয় পদস্থ ইংরেজ তার বাড়িতে চিরপ্রচলিত জগদ্ধাত্রীপূজায় শ্যাম্পেন-প্ৰসাদ ভুরিপরিমাণেই অন্তরস্থ করতেন। শৰ্মিলার বিবাহের পরে তার পত্নীহীন ঘরে ছিল বড়ো ছেলে হেমন্ত, আর ছোটাে মেয়ে উৰ্মিমালা । ছেলেটিকে অধ্যাপকবর্গ বলতেন দীপ্তিমান, ইংরেজিতে যাকে বলে ব্রিলিয়ান্ট । চেহারা ছিল পিছন ফিরে চেয়ে দেখবার মতো । এমন বিষয় ছিল না যাতে বিদ্যা না চড়েছে পরীক্ষামানের উর্ধর্বতম মার্কা পর্যন্ত । তা ছাড়া ব্যায়ামের উৎকর্ষে বাপের নাম রাখতে পারবে এমন লক্ষণ প্রবল। বলা বাহুল্য, তার চারি দিকে উৎকণ্ঠিত কন্যামণ্ডলীর কক্ষপ্ৰদক্ষিণ সবেগে চলছিল, কিন্তু বিবাহে তার মন তখনো উদাসীন। উপস্থিত লক্ষ ছিল যুরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি-সংগ্রহের দিকে। সেই উদ্দেশ্য মনে নিয়ে ফরাসি জর্মন শেখা শুরু করেছিল। আর কিছু হাতে না পেয়ে অনাবশ্যক হলেও আইন পড়া যখন আরম্ভ করেছে এমন সময় হেমন্তের অন্ত্রে কিংবা শরীরে কোন যন্ত্রে কী একটা বিকার ঘটল ডাক্তারেরা কিছুই তার কিনারা পেলেন না। গোপনচারী রোগ সবল দেহে যেন দুর্গের আশ্রয় পেয়েছে, তার খোজ পাওয়া যেমন শক্ত হল তাকে আক্রমণ করাও তেমনি । সেকালের এক ইংরেজ ডাক্তারের উপর রাজারামের ছিল অবিচলিত আস্থা । অস্ত্রচিকিৎসায় লোকটি যশস্বী । রোগীর দেহে সন্ধান শুরু করলেন। অন্ত্রব্যবহারের অভ্যাসবশত অনুমান করলেন, দেহের দুৰ্গম গহনে বিপদ আছে বদ্ধমূল, সেটা উৎপাটনযোগ্য। অন্ত্রের সুকৌশল সাহায্যে স্তর ভেদ করে যেখানটা অনাবৃত হল সেখানে কল্পিত শত্ৰুও নেই, তার অত্যাচারের চিহ্নও নেই । ভুল শোধরাবার রাস্তা রইল না, ছেলেটি মারা গেল। বাপের মনে বিষম দুঃখ কিছুতেই শান্ত ইতে চাইল না। মৃত্যু তাকে তত বাজে নি, কিন্তু আমন একটা সজীব সুন্দর বলিষ্ঠ দেহকে এমন করে খণ্ডিত কবার স্মৃতিটা দিনরাত র্তার মনের মধ্যে কালো হিংস্র পাখির মতো তীক্ষা নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে মইল । মৰ্ম শোষণ করে টানলে তাকে মৃত্যুর মুখে। s: নতুন-পাস-করা ডাক্তার, হেমন্তের পূর্বসহাধ্যায়ী, নীরদ মুখুজে ছিল শুশ্রুষার সহায়তা-কাজে বরাবর জোর করে সে বলে এসেছে, ভুল হচ্ছে। সে নিজে ব্যামের একটা স্বরূপ নির্ণয় করেছিল, পরামর্শ দিয়েছিল দীর্ঘকাল শুকনাে জায়গায় হাওয়া বদল করতে। কিন্তু রাজারামের মনে তাদের পৈত্রিক যুগের সংস্কার ছিল অটল। তিনি জানতেন যমের সঙ্গে দুঃসাধ্য লড়াই বাধলে তার উপযুক্ত \ኃ!| Sbr