পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ○8 রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র ইংরেজ ডাক্তার। এই ব্যাপারে নীরদের পরে অযথামাত্রায় তার স্নেহ ও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। তীর ছােটাে মেয়ে উর্মির অকস্মাৎ মনে হল, এ মানুষটার প্রতিভা অসামান্য । বাবাকে বললে, “দেখো তো বাবা, অল্প বয়স অথচ নিজের পরে কী দৃঢ় বিশ্বাস আর অতবড়ো হাড়-চওড়া বিলিতি ডাক্তারের মতের বিরুদ্ধে নিজের মতকে নিঃসংশয়ে প্রচার করতে পারে এমন অসংকুচিত সাহস ।” বাবা বললেন, “ডাক্তারি বিদ্যে কেবল শাস্ত্ৰগত নয়। কারও কারও মধ্যে থাকে ওটার দুর্লভ দৈব। সংস্কার । নীরদের দেখছি তাই ।” এদের ভক্তির শুরু হল একটা ছোটো প্ৰমাণ নিয়ে, শোকের আঘাতে, পরিতাপের বেদনায় । তার পরে প্রমাণের অপেক্ষা না করে সেটা আপনিই বেড়ে চলল । রাজারাম একদিন মেয়েকে বললেন, “দেখ উর্মি, আমি যেন শুনতে পাই, হেমন্ত আমাকে কেবলই ডাকছে, বলছে, “মানুষের রোগের দুঃখ দূর করো ।” স্থির করেছি। তার নামে একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করব ।” উর্মি তার স্বভাবসিদ্ধ উৎসাহে উচ্ছসিত হয়ে বললে, “খুব ভালো হবে। আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে যুরোপে, ডাক্তারি শিখে ফিরে এসে যেন হাসপাতালের ভার নিতে পারি।” কথাটা রাজারামের হৃদয়ে গিয়ে লাগল। বললেন, “ঐ হাসপাতাল হবে দেবত্র সম্পত্তি, তুই হবি সেবায়েত । হেমন্ত বড়ো দুঃখ পেয়ে গেছে, তোকে সে বড়ো ভালোবাসত, তোর এই পুণ্যকাজে পরলোকে সে শান্তি পাবে। তার রোগশয্যায় তুই তো দিনরাত্রি তার সেবা করেছিস, সেই সেবাই তোর হাতে আরো বড়ো হয়ে উঠবে ।” বনেদি ঘরের মেয়ে ডাক্তারি করবে। এটাও সৃষ্টিছাড়া বলে বৃদ্ধের মনে হল না। রোগের হাত থেকে মানুষকে বাচানো বলতে যে কতখানি বোঝায় আজ সেটা আপন মর্মের মধ্যে বুঝেছেন। তার ছেলে বঁচে নি, কিন্তু অন্যের ছেলেরা যদি বঁাচে তা হলে যেন তার ক্ষতিপূরণ হয়, তার শোকের লাঘব হতে পারে। মেয়েকে বললেন, “এখানকার য়ুনিভার্সিটিতে বিজ্ঞানের শিক্ষাটা শেষ হয়ে যাক আগে, তার পরে যুরোপে ।” এখন থেকে রাজারামের মনে একটা কথা ঘুরে বেড়াতে লাগল। সে ঐ নীরদ ছেলেটির কথা । একেবারে সোনার টুকরো। যত দেখছেন ততই লাগছে চমৎকার। পাস করেছে বটে, কিন্তু পরীক্ষার তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে গিয়ে ডাক্তারিবিদ্যের সাত সমুদ্রে দিনরাত সাতার কেটে বেড়াচ্ছে । অল্প বয়েস, অথচ আমোদপ্রমোদ কোনো কিছুতেই টলে না মন । হালের যতকিছু আবিষ্কার তাই আলোচনা করছে। যাদের পসার জমেছে। বলত, মুখেরা লাভ করে উন্নতি, যোগ্য ব্যক্তিরা লাভ করে গৌরব | কথাটা ংগ্রহ করেছে কোনো-একটা বই থেকে । অবশেষে একদিন রাজারাম উর্মিকে বললেন, “ভেবে দেখলুম, আমাদের হাসপাতালে তুই নীরদের সঙ্গিনী হয়ে কাজ করলেই কাজটা সম্পূর্ণ হবে, আর আমিও নিশ্চিন্ত হতে পারব। ওর মতো অমন ছেলে পাব কোথায় ।” ካኔ রাজারাম আর যাই পারুন হেমন্তের মতকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। সে বলত, মেয়ের পছন্দ উপেক্ষা করে বাপমায়ের পছন্দে বিবাহ ঘটানাে বর্বরতা। রাজারাম একদা তর্ক করেছিলেন, বিবাহ ব্যাপারটা শুধু ব্যক্তিগত নয়, তার সঙ্গে সংসার জড়িত, তাই বিবাহে শুধু ইচ্ছার দ্বারা নয় অভিজ্ঞতার দ্বারা চালিত হওয়ার দরকার আছে। তৰ্ক যেমনই করুন, অভিরুচি যেমনই থাক, হেমন্তের পরে তীর স্নেহ এত গভীর যে, তার ইচ্ছাই এ পরিবারে জয়ী হল। নীরদ মুখুজের এ বাড়িতে গতিবিধি ছিল। হেমন্ত ওর নাম দিয়েছিল আউল, অর্থাৎ প্যাচা। অর্থ ব্যাখ্যা করতে বললে সে বলত, ও মানুষটা পৌরাণিক, মাইথ'লজিকাল, ওর বয়েস নেই, কেবল বিদ্যে, তাই আমি ওকে বলি মিনার্ভার বাহন ।