পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন 8○○。 নীরদ এদের বাড়িতে মাঝে মাঝে চা খেয়েছে, হেমন্তর সঙ্গে তুমুল তর্ক চালিয়েছে, মনে মনে ডর্মিকে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে, কিন্তু ব্যবহারে করে নি যে তার কারণ, এ ক্ষেত্রে যথোচিত ব্যবহারটাই, ওৱা স্বভাবে নেই। ও আলোচনা করতে পারে, আলাপ করতে জানে না । যৌবনের উত্তাপ ওর মধ্যে যদি বা থাকে, তার আলোটা নেই। এইজন্যেই, যে-সব যুবকের মধ্যে যৌবনটা যথেষ্ট প্রকাশমান তাদের অবজ্ঞা করেই ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে । এই সকল কারণে ওকে উর্মির উমেদার-শ্রেণীতে গণ্য করতে কেউ সাহস করে নি। অথচ সেই প্রতীয়মান নিরাসক্তিই বর্তমান কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওর পরে উর্মির শ্রদ্ধাকে সম্রামের সীমায় টেনে এনেছিল । রাজারাম যখন স্পষ্ট করেই বললেন যে, যদি মেয়ের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে। তবে নীরদের সঙ্গে তার বিবাহ হলে তিনি খুশি হবেন তখন মেয়ে অনুকূল ইঙ্গিতেই মাথাটা নাড়লে । কেবল সেইসঙ্গে জানালে, এ দেশের এবং বিলেতের শিক্ষার পালা সমাধা করে বিবাহ তার পরিণামে । বাবা বললেন, “সেই কথাই ভালো, কিন্তু পরস্পরের সম্মতিক্রমে সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেলে আর কোনাে ভাবনা থাকে " নীরদের সম্মতি পেতে দেরি হয় নি, যদিও তার ভাবে প্রকাশ পেল, উদবাহবন্ধন বৈজ্ঞানিকের পক্ষে ত্যাগ স্বীকার, প্রায় আত্মঘাতের কাছাকাছি। বোধ করি এই দুর্যোগ কথঞ্চিৎ-উপশমের উপায়-স্বরূপে শর্ত রইল যে, পড়াশুনো এবং সকল বিষয়েই নীরদ উৰ্মিকে পরিচালনা করবে, অর্থাৎ ভাবী পত্নী-রূপে ওকে ধীরে ধীরে নিজের হাতে গড়ে তুলবে। সেটাও হবে বৈজ্ঞানিকভাবে, নীরদ উৰ্মিকে বললে, “পশুপক্ষীরা প্রকৃতির কারখানা থেকে বেরিয়েছে তৈরি জিনিস। কিন্তু মানুষ কঁচা মালমসলা । স্বয়ং মানুষের উপর ভার তাকে গড়ে তোলা ৷” উর্মি নম্রভাবে বললে, “আচ্ছা, পরীক্ষা করুন। বাধা পাবেন না।” নীরদ বললে, “তোমার মধ্যে শক্তি নানাবিধ আছে। তাদের বেঁধে তুলতে হবে তোমার জীবনের একটিমাত্র লক্ষ্যের চারিদিকে । তা হলেই তোমার জীবন অর্থ পাবে । বিক্ষিপ্তকে সংক্ষিপ্ত করতে হবে একটা অভিপ্ৰায়ের টানে, আঁটি হয়ে উঠবে, ডাইনামিক হবে, তবেই সেই একত্বকে বলা যেতে পারবে মরাল অর্গানিজম।” উর্মি পুলকিত হয়ে ভাবলে, অনেক যুবক ওদের চায়ের টেবিলে ওদের টেনিস কোর্টে এসেছে, কিন্তু ভাববার যোগ্য কথা তারা কখনাে বলে না, আর-কেউ বললে হাই তোলে। বস্তুত নিরতিশয় গভীরভাবে কথা বলবার একটা ধরন আছে। নীরদের । সে যাই বলুক উর্মির মনে হয় এর মধ্যে এ আশ্চর্য তাৎপর্য আছে। অত্যন্ত বেশি ইনটেলেকচুয়াল । রাজারাম ওঁর বড়ো জামাইকেও ডাকলেন । মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ উপলক্ষে চেষ্টা করলেন পরস্পরকে ভালো করে আলাপ করিয়ে দেবার | শশাঙ্ক শামিলাকে বলে, “ছেলেটা অসহ্য জেঠা ; ও মনে করে আমরা সবাই ওর ছাত্র, তাও পড়ে আছি শেষ বেঞ্চির শেষ কোণে ।” শৰ্মিলা হেসে বলে, “ওটা তোমার জেলাসি । কেন, আমার তো ওকে বেশ লাগে।” শৰ্মিলা বলে, “তা হলে তুমি হয়তো হাঁপ ছেড়ে বীচ, আমার কথা আলাদা।” শশাঙ্কের প্রতি নীরদেরও যে ভ্ৰাতৃভাব বেড়ে উঠছে তা মনে হয় না। মনে মনে বলে, “ও তো মজুর, ও কি বৈজ্ঞানিক । হাত আছে মাথাটা কই ।” শশাঙ্ক নীরদকে নিয়ে তার শ্যালীকে প্রায় ঠাট্টা করে । বলে, “এবার পুরোনো নাম বদলাবার দিন ७ील ।।” "ইংরেজি মতে ?” “না, বিশুদ্ধ সংস্কৃত মতো।” "নতুন নামটা শুনি ।”