পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ভালো লাগে। ওর নিজের ছেলেমানুষ তার কাছে এলে ঢেউ খেলিয়ে ওঠে । সেও তীর পরে কম অত্যাচার করে না । দিদি ওদের দুজনের এই দুরন্তপন দেখে তার শান্ত স্নিগ্ধ হাসি হাসেন । কখনো বা মৃদু তিরস্কারও করেন, কিন্তু সেটা তিরস্কারের ভান । নীরদ উপসংহারে বললে, “যেখানে তােমার নিজের স্বভাব প্রশ্ৰয় না পায় সেইখানেই তোমার থাকা চাই । আমি কাছে থাকলে ভাবনা থাকত না, কেননা আমার স্বভাব একেবারে তোমার বিপরীত । তোমার মন রক্ষে করতে গিয়ে তোমার মনকে মাটি করা, এ আমার দ্বারা কখনোই হতে পারত না ।” উর্মি মাথা নিচু করে বললে, “আপনার কথা আমি সর্বদাই স্মরণ রাখব।” নীরদ বললে, “আমি কতকগুলো বই তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি। তার যে-সব চ্যাপ্টারে দাগ দিয়েছি সেইগুলো বিশেষ করে পোড়ো, এর পরে কাজে লাগবে ।” উর্মির পক্ষে এই সাহায্যের দরকার ছিল । কেননা ইদানীং মাঝে মাঝে তার মনে কেবলই সন্দেহ আসছিল, ভাবছিল, “হয়তো প্রথম উৎসাহের মুখে ভুল করেছি। হয়তো ডাক্তারি। আমার ধাতের সঙ্গে ळिल6 क् ।।' - নীরদের দাগ-দেওয়া বইগুলো ওর পক্ষে শক্তি বাধনের কাজ করবে, ওকে টেনে নিয়ে চলতে পারবে উজান-পথে । নীরদ চলে গেলে উমি নিজের প্রতি আরো কঠিন অত্যাচার করলে শুরু । কলেজে যায়, আর বাকি সময় নিজেকে যেন একেবারে জেনেনার মধ্যে বদ্ধ করে রাখে । সারা দিন পরে বাড়ি ফিরে এসে যতই তার শ্রান্ত মন ছুটি পেতে চায় ততই সে নিষ্ঠুরভাবে তাকে অধ্যয়নের শিকল জড়িয়ে আটকে রাখে । পড়া এগোয় না, একই পাতার উপর বার বার করে মন বৃথা ঘুরে বেড়ায়, তবু হার মানতে চায় না । নীরদ উপস্থিত নেই বলেই তার দূরবতী ইচ্ছাশক্তি ওর প্রতি অধিক করে কাজ করতে লািগল । নিজের উপর সব চেয়ে ধিককার হয় যখন কাজ করতে করতে আগেকার দিনের কথা কেবলই ফিরে ফিরে মনে আসে। যুবকদলের মধ্যে ওর ভক্ত ছিল অনেক । সেদিন তাদের কাউকে বা উপেক্ষা করেছে, কারও প্রতি ওর মনের টানিও হয়েছিল । ভালোবাসা পরিণত হয় নি, কিন্তু ভালোবাসার ইচ্ছেটাই তখন মৃদুমন্দ বসন্তের হাওয়ার মতো মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ােত । তাই আপন-মনে গান গাইত গুন গুন করে, পছন্দসই কবিতা কপি করে রাখত খাতায় । মন অত্যন্ত উতলা হলে বাজাত সেতার } আজকাল এক-এক দিন সন্ধেবেলায় বইয়ের পাতায় যখন চোখ আছে তখন হঠাৎ চমকে উঠে জানতে পারে যে, তার মনে ঘুরছে এমন কোনো দিনের এমন কোনো মানুষের ছবি যে দিনকে যে মানুষকে পূর্বে সে কখনোই বিশেষভাবে আমল দেয় নি। এমন-কি, সে মানুষের অবিশ্রাম আগ্রহে সেদিন তাকে বিরক্ত করেছিল। আজ বুঝি তার সেই আগ্রহটািই নিজের ভিতরকার অতৃপ্তির বেদনাকে স্পর্শ করে করে যাচ্ছে, প্রজাপতির ক্ষণিক হালকা ডানা ফুলকে যেমন বসন্তের স্পর্শ দিয়ে যায়। এ-সব চিন্তাকে যত বেগে সে মন থেকে দূর করতে চায় সেই বেগের প্রতিঘাতই চিন্তাগুলিকে ততই ওর মনে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। নীরদের একখানা ফোটােগ্রাফ রেখেছে ডেস্কের উপর । তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে । সে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে, আগ্রহের চিহ্ন নেই। সে ওকে ডাকে না, তবে ওরা প্ৰাণ সাড়া দেবে কাকে । মনে মনে কেবলই জপ করে, “কী প্ৰতিভা ! কী তপস্যা ! কী নির্মল চরিত্র !! কী আমার অভাবনীয় সৌভাগ্য !’ একটা বিষয়ে নীরদের জিত হয়েছে, সে কথাটাও বলা দরকার । নীরদের সঙ্গে উর্মির বিবাহের সম্বন্ধ হলে শশাঙ্ক এবং সন্দিগ্ধমনা আরো দশজন বিদ্রুপ করে হেসেছিল। বলেছিল, রাজারামবাবু সাদা লোক, ঠাউরে বসেছেন। নীরদ আইডিয়ালিস্ট। ওর আইডিয়ালিজম যে গোপনে ডিম পড়ছে। উর্মির টাকার থলির মধ্যে, এ কথাটা কি লম্বা লম্বা সাধুবাক্য দিয়ে ঢাকা যায়। আপনাকে স্যাক্রিাফাইস করেছে। বৈকি, কিন্তু যে দেবতার কাছে তার মন্দিরটা ইস্পীরিয়াল ব্যাঙ্কে । আমরা সোজাসুজি শ্বশুরকে জানিয়ে থাকি, টাকার দরকার আছে, আর সে টাকা জলে পড়বে না, তীরই মেয়ের সেবায় লাগবে । ইনি মহৎ