পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88°C রবীন্দ্র-রচনাবলী রাধাগােবিন্দ উৰ্মির অনতিদূর সম্পর্কের আত্মীয়। কাকার কথাটার ইঙ্গিত ওকে বাজল। সন্দেহ এল মনে । ভাবতে লাগল, “দিদিকে হয়তো বলতে হবে।” এ দিকে নিজেকে ধাক্কা দিয়ে বার বার প্রশ্ন করছে, “যথোচিত দুঃখ হচ্ছে না কেন ।” ー এই সময়ে শৰ্মিলার রোগটা নিয়ে ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। ভাইয়ের কথা মনে পড়িয়ে ভয় লাগিয়ে দেয় । নানা ডাক্তার লাগল নানা দিক থেকে ব্যাধির আবাসগুহাটা খুঁজে বের করতে । শৰ্মিলা ক্লান্ত হাসি হেসে বললে, “সি আই ডি-দের হাতে অপরাধী যাবে ফসকে, খোচা খেয়ে মরবে নিরপরাধ।” କn: ' r এই সময়টাতেই শশাঙ্কর হাতে দুটাে ভারী কাজ এসেছিল। একটা গঙ্গার ধারে পাটকলে । আর-একটা টালিগঞ্জের দিকে, মীরপুরের জমিদারের নূতন বাগানবাড়িতে। পাটকলের কুলিবস্তির কাজটা শেষ করে দেবার মেয়াদ ছিল তিন মাসের । গোটকতক টিউবওয়েলের কাজ ছিল নানা জায়গায়। শশাঙ্কর একটুও ফুরসূত ছিল না। শৰ্মিলার ব্যামোটা নিয়ে প্রায় তাকে আটকা পড়তে হয়, অথচ উৎকণ্ঠা থাকে কাজের জন্যে । এত দিন ওদের বিবাহ হয়েছে, কিন্তু এমন কোনো ব্যামো শৰ্মিলার হয় নি যা নিয়ে শশাঙ্ককে কখনো বিশেষ করে ভাবতে হয়েছে। তাই এবারকার এই রোগটার উদবেগে ছেলেমানুষের মতো ছটফট করছে। ওর মন । কাজ কামাই করে ঘুরে ফিরে বিছানার কাছে নিরুপায়ভাবে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, জিজ্ঞাসা করে, “কেমন আছ ?” তখনই শৰ্মিলা উত্তর দেয়, “তুমি মিথ্যে ভেবাে না, আমি ভালোই আছি ।” সেটা বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু বিশ্বাস করতে একান্ত ইচ্ছা বলেই শশাঙ্ক অবিলম্বে বিশ্বাস করে ছুটি পায় । শশাঙ্ক বললে, “ ঢেঙ্কানলের রাজার একটা বড়ো কাজ আমার হাতে এসেছে । প্ল্যানটা নিয়ে দেওয়ানের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। যত শীঘ্ৰ পারি ফিরে আসব, ডাক্তার আসবার আগেই।” শৰ্মিলা অনুযোগ করে বললে, “আমার মাথার দিব্যি রইল, তাড়াতাড়ি করে কাজ নষ্ট করতে পারবে না ! বুঝতে পারছি। ওদের দেশে তোমার যাবার দরকার আছে। নিশ্চয় যেয়ো, না গেলে আমি ভালো থাকিব না । আমাকে দেখবার লোক ঢের আছে ।” প্ৰকাণ্ড একটা ঐশ্বৰ্য গড়ে তোলবার সংকল্প দিন-রাত জাগছে। শশাঙ্কের মনে । তার আকর্ষণ। ঐশ্বর্যে নয়, বড়োত্বে । বড়ো কিছুকে গড়ে তোলাতেই পুরুষের দায়িত্ব । অর্থ-জিনিসটাকে তুচ্ছ বলে অবজ্ঞা করা চলে তখনই যখন তাতে দিনপাত হয় মাত্র। যখন তার চুড়াকে সমুচ্চ করে তোলা যায় তখনই সর্বসাধারণে তাকে শ্রদ্ধা করে । উপকার পায় বলে নয়, তার বড়ো ত্ব দেখাটাতেই চিত্তস্ফুর্তি। শৰ্মিলার শিয়রে বসে শশাঙ্কর মনে যখন উদবেগে চলছে সেই মুহুর্তেই সে না ভেবে থাকতে পারে না তার কাজের সৃষ্টিতে অনিষ্টের আশঙ্কা ঘটছে কোনখানে । শৰ্মিলা জানে শশাঙ্কের এই ভাবনা কৃপণের ভাবনা নয়, নিজের অবস্থার নিমতল হতে জয়স্তম্ভ উর্ধের্ব গেথে তোলবার জন্যে পুরুষকারের ভাবনা ৷ শশাঙ্কের এই গৌরবে শৰ্মিলা গৌরবান্বিত । তাই, স্বামী যে ওর রোগের সেবা নিয়ে কাজে ঢ়িল দেবে এ তার পক্ষে সুখের হলেও ভালোই লাগে না । ওকে বার বার ফিরে পাঠায় তার কাজে । এ দিকে নিজের কর্তব্য নিয়ে শমিলার উৎকণ্ঠার সীমা নেই। সে রইল বিছানায় পড়ে, ঠাকুর-চাকররা কী কাণ্ড করছে কে জানে। মনে সন্দেহ নেই যে রান্নায় ঘি দিচ্ছে খারাপ, নাবার ঘরে যথাসময়ে গরম জল দিতে ভুলেছে, বিছানার চাদর বদল করা হয় নি, নর্দমাগুলোতে মেথরের বঁটা নিয়মিত পড়ছে না। ও দিকে ধোবার বাড়ির কাপড় ফর্দ মিলিয়ে বুঝে না নিলে কিরকম উলটাপালট হয় সে তো জানা আছে। থাকতে পারে না, লুকিয়ে বিছানা ছেড়ে তদন্ত করতে যায়, বেদনা বেড়ে ওঠে, জ্বর যায় চড়ে, ডাক্তার ভেবে পায় না। এ কী হল !