পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন । 886 অবকাশমাত্রে নয়, তার একটা রসময় স্বরূপ আছে। বস্তুত উর্মির নিজের ছুটির আনন্দ এখানকার সমস্ত শূন্যকে পূর্ণ করেছে, দিনরাত্রিকে চঞ্চল করে রেখেছে। সেই নিরন্তর চাঞ্চল্য কর্মক্লান্ত শশাঙ্কের রক্তকে দোলায়িত করে তোলে । অপর পক্ষে শশাঙ্ক উর্মিকে নিয়ে আনন্দিত, সেই প্ৰত্যক্ষ উপলব্ধিই উর্মিকে আনন্দ দেয়। এত কাল সেই সুখটাই উর্মি পায় নি। সে যে আপনার অস্তিত্বমাত্র দিয়ে কাউকে খুশি করতে পারে এই তথ্যটি অনেক দিন তার কাছে চাপা পড়ে গিয়েছিল, এতেই তার যথার্থ গৌরবহানি হয়েছিল । শশাঙ্কের খাওয়া-পরা অভ্যাসমত চলছে কি না, ঠিক সময়ে ঠিক জিনিসের জোগান হল কি হল না, সেটা এ বাড়ির প্রভুর মনে গীেণ হয়েছে আজ ; অমনিতেই, অকারণেই আছে প্রসন্ন। শৰ্মিলাকে সে বলে, “তুমি খুঁটিনাটি নিয়ে অত ব্যস্ত হচ্ছি কেন । অভ্যাসের একটু হেরফের হলে তো অসুবিধে হয় না, সে তো ভালোই লাগে ।।’ শশাঙ্কের মনটা এখন জোয়ার-ভাটার মাঝখানকার নদীর মতো। কাজের বেগটা থমথমে হয়ে এসেছে। একটু কোনো দেরিতেই বা বাধাতেই মুশকিল হবে, লোকসান হবে, এমনতরো উদবেগের কথা সদসর্বদা শোনা যায় না । সেরকম কিছু প্ৰকাশ হলে উর্মি তার গাম্ভীৰ্য ভেঙে দেয়, হেসে ওঠে, মুখের ভাবখানা দেখে বলে, “আজ তোমার জুজু এসেছিল বুঝি, সেই সবুজ-পাগড়ি-পরা কোনদেশী দালাল— ভয় দেখিয়ে গেছে বুঝি।” “আমি তাকে খুব চিনি । তুমি সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিলে, ও একলা বারান্দায় বসে ছিল । আমিই তাকে নানাকথা বলে ভুলিয়ে রেখেছিলুম। তার বাড়ি বিকানীয়রে ; তার স্ত্রী মরেছে মশারিতে আগুন লেগে, আর-একটা বিয়ের সন্ধানে আছে ।” “তা হলে এখন থেকে হিসেব করে সে রোজ আসবে, যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব । যত দিন স্ত্রীর ঠিকানা না মেলে। ততদিন তার স্বপ্নটা জমবে ।” “আমাকে বলে যেয়ো ওর কাছ থেকে কী কাজ আদায় করতে হবে । ভাব দেখে বোধ হয় আমি পারব ।” আজকাল শশাঙ্কের মুনফার খাতায় নিরেনব্বিইয়ের ওপারে যে মোটা অঙ্কগুলো চলৎ অবস্থায়, তারা মাঝে মাঝে যদি একটু সবুর করে সেটাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠবার মতো চাঞ্চল্য দেখা যায় না । সন্ধ্যাবেলায় রেডিয়োর কাছে কান পাতবার জন্যে শশাঙ্ক মজুমদারের উৎসাহ এত কাল অনভিব্যক্তি ছিল। আজকাল উর্মি যখন তাকে টেনে আনে তখন ব্যাপারটাকে তুচ্ছ এবং সময়টাকে ব্যর্থ মনে হয় না | এরোপ্লেন-ওড়া দেখবার জন্যে একদিন ভোরবেলা দমদম পর্যন্ত যেতে হল, বৈজ্ঞানিক কৌতুহল তার প্রধান আকর্ষণ নয় । নিউমার্কেটে শপিং করতে এই তার প্রথম হাতে-খড়ি । এর আগে শামিলা মাঝে মাঝে মাছমাংস ফলমূল শাকসবজি কিনতে সেখানে যেত। সে জানত, এ কাজটা বিশেষভাবে তারই বিভাগের । এখানে শশাঙ্ক যে তার সহযোগিতা করবে। এমন কথা সে কখনো মনেও করে নি, ইচ্ছেও করে নি । কিন্তু উমি তো কিনতে যায় না, কেবল জিনিসপত্র উলটেপালটে দেখে বেড়ায়, ঘেঁটে বেড়ায়, দর করে | শশাঙ্ক যদি কিনে দিতে চায় তার টাকার ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে নিজের ব্যাগে হাজতে রাখে । শশাঙ্কর কাজের দরদ উর্মি একটুও বোঝে না। কখনো কখনো অত্যন্ত বাধা দেওয়ায় শশাঙ্কর কাছে তিরস্কার পেয়েছে। তার ফল এমন শোকাবহ হয়েছিল যে তার শোচনীয়তা অপসারণ করবার জন্যে শশাঙ্ককে দ্বিগুণ সময় দিতে হয়েছে। এক দিকে উর্মির চোখে বাম্পসঞ্চার, অন্য দিকে অপরিহার্য কাজের তাড়া । তাই, সংকটে পড়ে অবশেষে বাড়ির বাইরে চেম্বারেই ওর সমস্ত কাজকর্ম সেরে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু অপরাহু পেরোলেই সেখানে থাকা দুঃসহ হয়ে ওঠে। কোনাে কারণে যেদিন বিশেষ দেরি করে সেদিন উর্মির অভিমান দুর্ভেদ্য মীেনের অন্তরালে দুরভিভব হয়ে ওঠে । এই