পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88V রবীন্দ্র-রচনাবলী রুদ্ধ অশ্রুতে কুহেলিকাচ্ছন্ন অভিমানটা ভিতরে ভিতরে শশাঙ্ককে আনন্দ দেয়। ভালোমানুষটির মতো বলে, “উমি, কথা কইবে না। এ সত্যাগ্ৰহ রক্ষা করাই উচিত । কিন্তু দোহাই ধর্ম, খেলবে না। এমন পণ তো ছিল না ।” তার পরে টেনিস-ব্যাট হাতে করে চলে আসে। খেলায় শশাঙ্ক জিতের কাছাকাছি এসে ইচ্ছে করেই হারে । নষ্ট সময়ের জন্যে আবার পরের দিন সকালে উঠেই অনুতাপ করতে থাকে। কোনো-একটা ছুটির দিনে বিকালবেলায় শশাঙ্ক যখন ডান হাতে লাল-নীল পেন্সিল নিয়ে বা আঙুলগুলো দিয়ে অকারণে চুল উস্কো খুল্কো করতে করতে আপিসের ডেস্কে বসে কোনাে-একটা দুঃসাধ্য কাজের উপর ঝুকে পড়েছে, উর্মি এসে বলে, “তোমার সেই দালালের সঙ্গে ঠিক করেছি। আজ আমাকে পরেশনাথের মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে । চলে আমার সঙ্গে । লক্ষ্মীটি ।” শশাঙ্ক মিনতি করে বলে, “না ভাই, আজ না, এখন আমার ওঠবার জো নেই।” কাজের গুরুত্বে উমি একটুও ভয় পায় না । বলে, “অবলা রমণীকে অরক্ষিত অবস্থায় সবুজ-পাগড়ি-ধারীর হাতে সমর্পণ করে দিতে সংকোচ নেই, এই বুঝি তোমার শিভলরি ” শেষকালে ওর টানাটানিতে শশাঙ্ক কাজ ফেলে যায় মোটর হাকিয়ে । এইরকম উৎপাত চলছে টের পেলে শর্মিলা বিষম বিরক্ত হয়। কেননা, ওর মতে পুরুষের সাধনার ক্ষেত্রে মেয়েদের অনধিকার প্ৰবেশ কোনোমতেই মার্জনীয় নয় । উর্মিকে শৰ্মিলা বরাবর ছেলেমানুষ বলেই জেনেছে। আজও সেই ধারণাটা ওর মনে আছে। তা হােক, তাই বলে আপিস-ঘর তো ছেলেখেলার জায়গা নয় । তাই, উমিকে ডেকে যথেষ্ট কঠিনভাবেই তিরস্কার করে । সে তিরস্কারের নিশ্চিত ফল হতে পারত, কিন্তু স্ত্রীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে শশাঙ্ক স্বয়ং দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে উৰ্মিকে আশ্বাস দিয়ে চােখ টিপতে থাকে। তাসের প্যাক দেখিয়ে ইশারা করে, ভাবখানা এই যে, “চলে এসো, আপিস-ঘরে বসে তোমাকে পোকার খেলা শেখাব ।’ এখন খেলার সময় একেবারেই নয়, এবং খেলবার কথা মনে আনবারও সময় ও অভিপ্ৰায় ওর ছিল না। কিন্তু দিদির কঠোর ভৎসনায় উর্মির মনে বেদনা লাগছে, এটা তাকে যেন উর্মির চেয়েও বেশি বাজে । ও নিজেই তাকে অনুনয়, এমন-কি, ঈষৎ তিরস্কার করে কাজের ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে রাখতে পারত, কিন্তু শৰ্মিলা যে এই নিয়ে উৰ্মিকে শাসন করবে। এইটে সহ্য করা ওর পক্ষে বড়ো কঠিন । শৰ্মিলা শশাঙ্ককে ডেকে বলে, “তুমি ওর সব আবদার এমন করে শুনলে চলবে কেন । সময় নেই, অসমীয় নেই, তোমার কাজের লোকসান হয় যে ।” শশাঙ্ক বলে, “আহা ছেলেমানুষ, এখানে ওর সঙ্গী নেই কেউ, একটু খেলাধুলো না পেলে বাঁচবে কেন ।” ' এই তো গেল নানাপ্রকার ছেলেমানুষি। ও দিকে শশাঙ্ক যখন বাড়ি-তৈরির প্ল্যান নিয়ে পড়ে, ওঁ তার পাশে চৌকি টেনে নিয়ে এসে বলে “বুঝিয়ে দাও” । সহজেই বোঝে, গাণিতিক নিয়মগুলো জটিল ঠেকে না। শশাঙ্ক ভারি খুশি হয়ে উঠে ওকে প্রবলেম দেয়, ও কষে নিয়ে আসে। জুট কোম্পানির স্টীমলঞ্চে শশাঙ্ক কাজ তদন্ত করতে যায়, ও ধরে বসে। ‘আমিও যাব । শুধু যায় তা নয়, মাপজোখের হিসাব নিয়ে তর্ক করে, শশাঙ্ক পুলকিত হয়ে ওঠে । ভরপুর কবিত্বের চেয়ে এর রস বেশি। এখন তাই চেম্বারের কাজ যখন বাড়িতে নিয়ে আসে তা নিয়ে ওর মনে আশঙ্কা থাকে না । লাইন টানা, আঁক কষার কাজে তার সঙ্গী জুটেছে। উর্মিকে পাশে নিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কাজ এগোয়। খুব দ্রুত বেগে এগোয় না বটে, কিন্তু সময়ের দীর্ঘতাকে সার্থক মনে হয় । এইখানটাতে শৰ্মিলাকে রীতিমত ধাক্কা দেয়। উর্মির ছেলেমানুষিও সে বোঝে, তার গৃহিণীপনার ক্রটিও সস্নেহে সহ্য করে, কিন্তু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীবুদ্ধির দূরত্বকে স্বয়ং অনিবাৰ্য বলে মেনে নিয়েছিল— সেখানে উর্মির অবাধে গতিবিধি ওর একটুও ভালো লাগে না। ওটা নিতান্তই স্পর্ধা । আপনি আপনি সীমা মেনে চলাকেই গীতা বলেন স্বধর্ম। " মনে মনে অত্যন্ত অধীর হয়েই একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা উর্মি, তোর কি ঐ-সব আঁকাজোখা, আঁকি কষা, ট্রেস করা সত্যিই ভালো লাগে ?” ।