পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন 88 কিন্তু মুশকিল। এই যে, অপর পক্ষ থেকে কোনো জোর পায় না । উর্মি যেন এমন একটি গাছ যা মাটিকে আঁকড়ে আছে, কিন্তু আকাশের আলো থেকে বঞ্চিত, পাতাগুলো পাণ্ডুবৰ্ণ হয়ে আসে। এক-এক সময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে ; মনে মনে ভাবে, এ মানুষটা চিঠির মতো চিঠি লিখতে পারে না কেন । উর্মি অনেক কাল কনভেন্টে পড়েছে। আর-কিছু না হােক ইংরেজিতে ওর বিদ্যে পাকা । সে কথা নীরদের জানা ছিল। সেইজন্যেই, ইংরেজি লিখে নীরদ ওকে অভিভূত করবে। এই ছিল তার পণ । বাংলায় চিঠি লিখলে বিপদ বঁাচত, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে বেচারা জানে না যে সে ইংরেজি জানে না । ভারী ভারী শব্দ জুটিয়ে এনে, পুঁথিগত দীর্ঘপ্রস্থ বচন যোজনা করে, ওর বাক্যগুলোকে করে তুলত বস্তা-বোঝাই গোরুর গাড়ির মতো । উমির হাসি আসত, কিন্তু হাসতে সে লজ্জা পেত ; নিজেকে তিরস্কার করে বলত, বাঙালির ইংরেজিতে ক্ৰটি হলে তা নিয়ে দোষ ধরা সুবিশ । দেশে থাকতে মোকাবিলায় যখন নীরদ ক্ষণে ক্ষণে সদুপদেশ দিয়েছে তখন ওর রকম-সকমে সেগুলো গভীর হয়ে উঠেছে গৌরবে । যতটা কানে শোনা যেত তার চেয়ে আন্দাজে তার ওজন হত বেশি । কিন্তু লম্বা চিঠিতে আন্দাজের জায়গা থাকে না । কোমর-বাধা ভারী ভারী কথা হালকা হয়ে যায়, মোটা মোটা আওয়াজেই ধরা পড়ে বলবার বিষয়ের কমতি । নীরদের যে ভাবটা কাছে থাকতে ও সয়ে গিয়েছিল সেইটো দূরের থেকে ওকে সব চেয়ে বাজে। লোকটা একেবারেই হাসতে জানে না। চিঠিতে সব চেয়ে প্রকাশ পায় সেই অভাবটা । এই নিয়ে শশাঙ্কের সঙ্গে তুলনা ওর মনে আপনিই এসে পড়ে। তুলনার একটা উপলক্ষ এই সেদিন হঠাৎ ঘটেছে। কাপড় খুঁজতে গিয়ে বাক্সের তলা থেকে বেরোল পশমে-বোনা একপাটি অসমাপ্ত জুতো । মনে পড়ে গেল চার বছর আগেকার কথা। তখন হেমন্ত ছিল বেঁচে । ওরা সকলে মিলে গিয়েছিল দাৰ্জিলিঙে । আমোদের অন্ত ছিল না । হেমন্তে আর শশাঙ্কে মিলে ঠাট্টােতামাশার পাগলা-বোরা বইয়ে দিয়েছিল । উমি তার এক মাসির কাছ থেকে পশমের কাজ নতুন শিখেছে। জন্মদিনে দাদাকে দেবে বলে একজোড়া জুতো বুনছিল। তা নিয়ে শশাঙ্ক ওকে কেবলই ঠাট্টা করত ; বলত, “দাদাকে আর যাই দাও, জুতো নয় । ভগবান মনু বলেছেন ওতে গুরুজনের অসম্মান হয় ।” উর্মি কটাক্ষ করে বলেছিল, “ভগবান মনু, তবে কাকে প্রয়োগ করতে বলেন।” শশাঙ্ক গভীর মুখে বললে, “অসম্মানের সনাতন অধিকার ভগ্নীপতির । আমার পাওনা আছে। সেটা সুদে ভারী হয়ে উঠল।” “মনে তো পড়ছে না ।” “পড়বার কথা নয়, তখন ছিলো নিতান্ত নাবালিকা ৷ সেই কারণেই তোমার দিদির সঙ্গে শুভলগ্নে যেদিন এই সৌভাগ্যবানের বিবাহ হয়, সেদিন বাসররজনীর কর্ণধারপদ গ্ৰহণ করতে পার নি। আর সেই কোমল করপল্লবের অরচিত কান-মলাটাই রূপ গ্ৰহণ করছে সেই কারপন্নবরচিত জুতো যুগলে । ওটার প্রতি আমার দাবি রইল জানিয়ে রেখে দিলুম।” দাবি শোধ হয় নি, সে জুতো যথাসময়ে প্ৰণামীরূপে নিবেদিত হয়েছিল দাদার চরণে। তার পর কিছুকাল পরে শশাঙ্কর কাছ থেকে উর্মি একখানি চিঠি পেল। পেয়ে খুব হেসেছে সে। সেই চিঠি আজও তার বাক্সে আছে। আজ খুলে সে আবার পড়লে কাল তো তুমি চলে গেলে । তোমার স্মৃতি পুরাতন হতে না হতে তোমার নামে একটা কলঙ্ক রটনা হয়েছে, সেটা তোমার কাছে গোপন করা অকর্তব্য মনে করি । আমার পায়ে একজোড়া তালতলীয় চটি অনেকেই লক্ষ্য করেছে। কিন্তু তার চেয়ে লক্ষা করেছে তার ছিদ্র ভেদ করে আমার চরণনখরপঙক্তি মেঘমুক্ত চন্দ্ৰমালার মতো । (ভারতচন্দ্রর অন্নদামঙ্গল দ্রষ্টব্য। উপমার যথার্থ সম্বন্ধে সন্দেহ ঘটলে তোমার দিদির কাছে মীমাংসনীয়।) আজ সকালে আমার আপিসের বৃন্দাবন নদী যখন আমার সপাদুক চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলে তখন Vel Nd