পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 to রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমার পদমর্যাদায় যে বিদীর্ণতা প্ৰকাশ পেয়েছে তারই অগৌরব মনে আন্দোলিত হল । সেবককে জিজ্ঞাসা করলেম, মহেশ, আমার সেই অন্য নূতন চটিজোড়াটা গতিলাভ করেছে। অন্য কোন অনধিকারীর শ্ৰীচরণে। সে মাথা চুলকিয়ে বললে, “ও বাড়ির উর্মিমাসিদের সঙ্গে আপনিও যখন দাৰ্জিলিঙ যান সেই সময়ে চটিজোড়াটাও গিয়েছিল। আপনি ফিরে এসেছেন সেইসঙ্গে ফিরে এসেছে তার একপাটি, আর-এক পাটি-” তার মুখ লাল হয়ে উঠল। আমি এক ধমক দিয়ে বললুম, “ব্যস, চুপ।” সেখানে অনেক লোক ছিল। চটিজুতো-হরণ হীনকার্য। কিন্তু মানুষের মন দুর্বল, লোভ দুৰ্দম, এমন কাজ করে ফেলে, ঈশ্বর বোধ করি ক্ষমা করেন। তবু অপহরণ-কাজে বুদ্ধির পরিচয় থাকলে দুষ্কার্যের গ্লানি অনেকটা কাটে। কিন্তু একপাটি চটি !!! ধিক !!! যে এ কাজ করেছে, যথাসাধ্য তার নাম আমি উহ্য রেখেছি। সে যদি তার স্বভাবসিদ্ধ মুখরতার সঙ্গে এই নিয়ে অনর্থক চেচামেচি করে তা হলে কথাটা ঘাটাঘাটি হয়ে যাবে। চটি নিয়ে চটচটি সেইখানেই খাটে যেখানে মন খাটি । মহেশের মতো নিন্দুকের মুখ বন্ধ এখনই করতে পার একজোড়া শিল্পকাৰ্যখচিত চটির সাহায্যে । যেমন তার আস্পর্ধা ! পায়ের মাপ। এইসঙ্গে পাঠাচ্ছি। চিঠিখানা পেয়ে উর্মি স্মিতমুখে পশমের জুতো বুনতে বসেছিল, কিন্তু শেষ করে নি। পশমের কাজে আর তার উৎসাহ ছিল না। আজ এটা আবিষ্কার করে স্থির করলে এই অসমাপ্ত জুতোটাই দেবে শশাঙ্ককে সেই দাৰ্জিলিঙ-যাত্রার সাম্বাৎসরিক দিনে । সেদিন আর কয়েক সপ্তাহ পরেই আসছে। গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল— হায় রে, কোথায় সেই হাস্যোজুল আকাশে হালকা পাখায় উড়ে-যাওয়া দিনগুলি ! এখন থেকে সামনে প্রসারিত নিরবকাশ কর্তব্যকঠোর মরুজীবন। আজ ২৬শে ফাল্পন। হােলিখেলার দিন । মফঃস্বলের কাজে এ খেলায় শশাঙ্কের সময় ছিল না, এদিনের কথা তারা ভুলেই গেছে। উমি আজ তার শয্যাগত দিদির পায়ে আবীরের টিপ দিয়ে প্ৰণাম করেছে। তার পরে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলে, শশাঙ্ক আপিস-ঘরের ডেস্কে ঝুকে পড়ে একমনে কাজ করছে । পিছন থেকে গিয়ে দিলে তার মাথায় আবীর মাখিয়ে, রাঙিয়ে উঠল তার কাগজপত্র । মাতামতির পালা পড়ে গেল। ডেস্কে ছিল দোয়াতে লাল কালি। শশাঙ্ক দিলে উর্মির শাড়িতে ঢেলে । হাত চেপে ধরে তার আঁচল থেকে ফাগ কেড়ে নিয়ে উর্মির মুখে দিলে ঘষে, তার পরে দৌড়াদৌড়ি, ঠেলা ঠেলি, চেঁচামেচি । বেলা যায় চলে, স্নানাহারের সময় যায় পিছিয়ে, উমির উচ্চহাসির স্বরোচ্ছাসে সমস্ত বাড়ি মুখরিত। শেষকালে শশাঙ্কের অস্বাস্থ্য-আশঙ্কায় দূতের পরে দূত পাঠিয়ে শৰ্মিলা এদের নিবৃত্ত করলে । দিন গেছে। রাত্রি হয়েছে অনেক । পুষ্পিত কৃষ্ণচুড়ার শাখাজাল ছাড়িয়ে পূৰ্ণচাঁদ উঠেছে অনাবৃত আকাশে । হঠাৎ ফায়ুনের দমকা হাওয়ায় ঝরঝর শব্দে দোলাদুলি করে উঠেছে বাগানের সমস্ত গাছপালা, তলাকার ছায়ার জাল তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। জানলার কাছে উমি চুপ করে বসে । ঘুম আসছে না কিছুতেই। বুকের মধ্যে রক্তের দোলা শান্ত হয় নি। আমের বোলের গন্ধে মন উঠেছে। ভরে । আজ বসন্তে মাধবীলতার মজ্জায় মজায় যে ফুল ফোটাবার বেদনা সেই বেদনা যেন উর্মির সমস্ত দেহকে ভিতর থেকে উৎসুক করেছে। পাশের নাবার ঘরে গিয়ে মাথা ধুয়ে নিলে, গা মুছলে ভিজে তোয়ালে দিয়ে। বিছানায় শুয়ে এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে কিছুক্ষণ পরে স্বপ্নজড়িত ঘুমে রাত্রি তিনটের সময় ঘুম ভেঙেছে। চাদ তখন জানলার সামনে নেই। ঘরে অন্ধকার, বাইরে আলোয় ছায়ায় জড়িত সুপারিগাছের বীথিকা । উর্মির বুক ফেটে কান্না এল, কিছুতে থামতে চায় না। উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুজে কঁদিতে লাগল। প্রাণের এই কান্না— ভাষায় এর শব্দ নেই, অর্থ নেই। প্রশ্ন করলে ও কি বলতে পারে, কোথা থেকে এই বেদনার জোয়ার উদবেলিত হয়ে ওঠে। ওর দেহে মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিনের কর্মতালিকা, রাত্রের সুখনিদ্ৰা ? সকালে উমি যখন ঘুম ভেঙে উঠল তখন ঘরের মধ্যে রোেন্ত্র এসে পড়েছে। সকালবেলাকার কাজে