পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী ass কিছুকাল এইরকম যায়। লািগল চােখে ঘোর, মন উঠল আবিল হয়ে । নিজেকে সুস্পষ্ট বুঝতে উর্মির সময় লেগেছে, কিন্তু একদিন হঠাৎ চমকে উঠে বুঝলে। মথুরদাদাকে উর্মি কী জানি কেন ভয় করত, এড়িয়ে বেড়ােত তাকে । সেদিন মথুর সকালে দিদির ঘরে এসে বেলা দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে গেল। : তার পরে দিদি উৰ্মিকে ডেকে পাঠালে। মুখ তার কঠোর, অথচ শান্ত । বললে, “প্রতিদিন ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে কী কাণ্ড করেছিস জানিস, তা ?” উমি ভয় পেয়ে গেল । বললে, “কী হয়েছে দিদি ।” দিদি বললে, “মথুরদাদা জানিয়ে গেল, কিছুদিন ধরে তোর ভগ্নীপতি নিজে কাজ একেবারে দেখেন নি। জহরলালের উপরে ভার দিয়েছিলেন ; সে মালমসলায় দুহাত চালিয়ে চুরি করেছে। বড়ো বড়ো গুদামঘরের ছাদ একেবারে বঁাজরা ; সেদিনকার বৃষ্টিতে ধরা পড়েছে মাল যাচ্ছে নষ্ট হয়ে । আমাদের কোম্পানির মস্ত নাম, তাই ওরা পরীক্ষা করে নি, এখন মস্ত অখ্যাতি এবং লোকসানের দায় পড়েছে ঘাড়ে । মথুরদাদা স্বতন্ত্র হবেন ।” উর্মির বুক ধক করে উঠল, মুখ হয়ে গেল পাশের মতো। এক মুহুর্তে বিদ্যুতের আলোয় আপন মনের প্রচ্ছন্ন রহস্য প্ৰকাশ পেলে । স্পষ্ট বুঝলে, কখন অজ্ঞাতসারে তার মনের ভিতরটা উঠেছিল মাতাল হয়ে, ভালোমন্দ কিছুই বিচার করতে পারে নি। শশাঙ্কর কাজটাই যেন ছিল তার প্রতিযোগী, তারই সঙ্গে ওর আড়াআড়ি । কাজের থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে সর্বদা সম্পূর্ণ কাছে পাবার জন্যে উর্মি কেবল ভিতরে ভিতরে ছটফট করত । কতদিন এমন ঘটেছে, শশাঙ্ক যখন স্নানে এমন সময় কাজের কথা নিয়ে লোক এসেছে ; উমি কিছু না ভেবে বলে পাঠিয়েছে, “বল গে, এখন দেখা হবে না।” ভয়, পাছে স্নান করে এসেই শশাঙ্ক আর অবকাশ না পায়, পাছে এমন করে কাজে জড়িয়ে পড়ে যে উর্মির দিনটা হয় ব্যৰ্থ। তার দুরন্ত নেশার সাংঘাতিক ছবিটা সম্পূর্ণ চােখে জেগে উঠল। তৎক্ষণাৎ দিদির পায়ের উপর আছড়ে খেয়ে পড়ল। বার বার করে রুদ্ধপ্ৰায় কণ্ঠে বলতে লাগল, “তাড়িয়ে দাও তোমাদের ঘর থেকে আমাকে, এখনই দূর করে তাড়িয়ে দাও।” আজ দিদি নিশ্চিত স্থির করে বসেছিল, কিছুতেই উর্মিকে ক্ষমা করবে না। মন গেল গলে। আস্তে আস্তে উৰ্মিমালার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, “কিছু ভাবিস নে, যা হয় একটা উপায় হবে।” উমি উঠে বসল। বললে, “দিদি, তোমাদেরই বা কেন লোকসান হবে । আমারও তো টাকা আছে ।” শর্মিলা বললে, “পাগল হয়েছিস । আমার বুঝি কিছু নেই। মথুরদাদাকে বলেছি, এই নিয়ে তিনি যেন কিছু গোল না করেন। লোকসান আমি পুরিয়ে দেব। আর, তোকেও বলছি, আমি যে কিছু জানতে পেরেছি এ কথা যেন তোর ভগ্নীপতি না টের পান ।” “মাপ করো, দিদি, আমাকে মাপ করো” এই বলে উমি আবার দিদির পায়ের উপর পড়ে মাথা ঠুকতে লাগল। শৰ্মিলা চোখের জল মুছে ক্লান্ত সুরে বললে, “কে কাকে মাপ করবে, বোন। সংসারটা বড়ো জটিল। যা মনে করি তা হয় না, যার জন্যে প্রাণপণ করি তা যায় ফেসে ।” । দিদিকে ছেড়ে উমি এক মুহুর্ত নড়তে চায় না- ওষুধপত্র দেওয়া, নাওয়ানো, খাওয়ানো, শোওয়ানো সমস্ত খুঁটিনাটি নিজের হাতে । আবার বই পড়তে আরম্ভ করেছে, সেও দিদির বিছানার পাশে বসে। নিজেকেও আর বিশ্বাস করে না, শশাঙ্ককেও না। : ফল হল এই যে, শশাঙ্ক বার বার আসে রোগীর ঘরে । পুরুষমানুষের অন্ধতাবশতই বুঝতে পারে। না ছটফটানির তাৎপর্যন্ত্রীর কাছে পড়ছে ধরা, লজ্জায় মরছে। উর্মি। শশাঙ্ক আসে মোহনবাগান ফুটবল ম্যাচের প্রলোভন নিয়ে, ব্যর্থ হয়। পেনসিলের দাগ দেওয়া খবরের কাগজ মেলে দেখায় বিজ্ঞাপনে