পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(2Wり রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী এ কথা দিদি বার বার করে উর্মিকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তার অবর্তমানে সব চেয়ে যেটা সান্তনার বিষয় সে উৰ্মিকে নিয়েই । এ সংসারে অন্য কোনো মেয়ের আবির্ভাব কল্পনা করতেও দিদিকে বাজত, অথচ শশাঙ্ককে যত্ন করবার জন্যে কোনো মেয়েই থাকবে না। এমন লক্ষ্মীছাড়া অবস্থাও দিদি মনে মনে সইতে পারত না । ব্যাবসার কথাও দিদি ওকে বুঝিয়েছে ; বলেছে, যদি ভালোবাসায় বাধা পায় তা হলে সেই ধাক্কায় ওর কাজকর্ম সব যাবে নষ্ট হয়ে । ওর মন যখন তৃপ্ত হবে তখনই আবার কাজকর্মে আপনি আসবে শৃঙ্খলা । শশাঙ্কের মন উঠেছে মেতে । ও এমন একটা চন্দ্ৰলোকে আছে যেখানে সংসারের সব দায়িত্ব সুখতন্দ্ৰায় লীন। আজকাল রবিবার-পালনে বিশুদ্ধ খৃস্টানের মতোই ওর অশ্বলিত নিষ্ঠা। একদিন শমিলাকে গিয়ে বললে, “দেখো, পাটের সাহেবদের কাছে তাদের স্টীমলঞ্চ পাওয়া গেছে- কাল রবিবার, মনে করছি ভোরে উমিকে নিয়ে ডায়মন্ডহারবারের কাছে যাব, সন্ধ্যার আগেই আসব ফিরে ।” শৰ্মিলার বুকের শিরাগুলো কে যেন দিলে মুচড়ে, বেদনায় কপালের চামড়া উঠল কুঞ্চিত হয়ে। শশাঙ্কের চোখেই পড়ল না । শৰ্মিলা কেবল একবার জিজ্ঞাসা করলে, “খাওয়াদাওয়ার কী হবে।” শশাঙ্ক বললে, “হােটেলের সঙ্গে ঠিক করে রেখেছি।” একদিন এই সমস্ত ঠিক করবার ভার যখন ছিল শর্মিলার উপর তখন শশাঙ্ক ছিল। উদাসীন । আজ সমস্ত উলটাপালট হয়ে গেল । যেমনি শর্মিলা বললে, “আচ্ছা, তা যেয়ো” অমনি মুহুর্ত অপেক্ষা না করে শশাঙ্ক বেরিয়ে গেল ছুটে । শৰ্মিলার ডাক ছেড়ে কাদতে ইচ্ছা করল । বালিশের মধ্যে মুখ গুজে বার বার করে বলতে লাগল, “আর কেন আছি বেঁচে ।” w কাল রবিবারে ছিল ওদের বিবাহের সাম্বাৎসরিক । আজ পর্যন্ত এ অনুষ্ঠানে কোনো দিন ছেদ পড়ে নি । এবারেও স্বামীকে না বলে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমস্ত আয়োজন করছিল । আর-কিছুই নয়, বিয়ের দিন শশাঙ্ক যে লাল বেনারসির জোড় পরেছিল সেইটে ওকে পরাবে, নিজে পারবে বিয়ের চেলি। স্বামীর গলায় মালা পরিয়ে ওকে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে- জ্বালাবে ধূপবাতি, পাশের ঘরে গ্রামোফোনে বাজবে সানাই। অন্যান্য বছর শশাঙ্ক ওকে আগে থাকতে না জানিয়ে একটা-কিছু শখের জিনিস কিনে দিত । শামিলা ভেবেছিল ‘এবারেও নিশ্চয় দেবে, কাল পাব জানতে ” আজ ও আর কিছুই সহ্য করতে পারছে না। ঘরে যখন কেউ নেই তখন কেবলই বলে বলে উঠছে, “মিথ্যে ! মিথ্যে ! মিথ্যে ! কী হবে এই খেলায় ?” রাত্রে ঘুম হল না । জুলু ভুলুশ্ৰুগড় দরজার কাছ থেকে চলে গেল । শামিলা . থ্য ।” r এখন থেকে রোগ দ্রুত বেড়ে চলল। দুর্লক্ষণ যেদিন অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে সেদিন শর্মিলা ডেকে পাঠালে স্বামীকে । সন্ধ্যাবেলা, ক্ষীণ আলো ঘরে, নার্সকে সংকেত করলে চলে যেতে । স্বামীকে পাশে বসিয়ে হাতে ধরে বললে, “জীবনে আমি যে বর পেয়েছিলুম ভগবানের কাছে সে তুমি । তার যোগ্য শক্তি আমাকে দেন নি। সাধ্যে যা ছিল করেছি। ক্ৰটি অনেক হয়েছে, মাপ কোরো আমাকে ৷” শশাঙ্ক কী বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে বললে, “না, কিছু বোলো না। উর্মিকে দিয়ে গেলুম তোমার হাতে। সে আমার আপনি বোন। তার মধ্যে আমাকেই পাবে, আরো অনেক বেশি পাবে যা আমার মধ্যে পাও নি। না, চুপ করো, কিছু বোলো না। মরবার কালেই আমার সৌভাগ্য পূর্ণ হল, তোমাকে সুখী করতে পারলুম।” নার্স বাইরে থেকে বললে, “ডাক্তারবাবু এসেছেন।” শৰ্মিলা বললে, “ডেকে দাও।” কথাটা বন্ধ হয়ে গেল ।