পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(ሱbr রবীন্দ্র-রচনাবলী বেড়ে যাবে। দারিদ্র্যের কঠোরতাকে যথাসম্ভব মৃদু করে এনে দিন চালাতে পারবে, এ বিশ্বাস ওৱ আছে। বিশেষত গয়না যা হাতে রইল তা নিয়ে এখনো কিছুকাল বিশেষ দুঃখ পেতে হবে না। এ কথাটাও সসংকোচে মনে উকি মেরেছে যে, উর্মির সঙ্গে বিয়ে হলে তার সম্পত্তিও তো স্বামীরই হবে। কিন্তু শুধু জীবনযাত্রাই তো যথেষ্ট নয়। এত দিন ধরে নিজের শক্তিতে নিজের হাতে স্বামী যে সম্পদ সৃষ্টি করে তুলেছিল, যার খাতিরে আপনি হৃদয়ের অনেক প্রবল দাবিকেও শর্মিলা ইচ্ছে করে দিনে দিনে ঠেকিয়ে রেখেছে, সেই ওদের উভয়ের সম্মিলিত জীবনের মূর্তিমান আশা আজ মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল, এরই আগৌরব ওকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে । মনে মনে বলতে লাগল, তখনই যদি মরতুম তা হলে তো এই ধিককারটা বঁাচত আমার । আমার ভাগ্যে যা ছিল তা তো হল, কিন্তু দৈন্য-অপমানের এই নিদারুণ শূন্যতা একদিন কি পরিতাপ আনবে না। ওঁর মনে । যার মোহে অভিভূত হয়ে এটা ঘটতে পারল একদিন হয়তো তাকে মাপ করতে পারবেন না, তীর দেওয়া অন্ন ওঁর মুখে বিষ ঠেকবে । নিজের মাতলামির ফল দেখে লাজা পাবেন, কিন্তু দোষ দেবেন। মদিরাকে । যদি অবশেষে উর্মির সম্পত্তির উপর নির্ভর করা অবশ্য হয়ে ওঠে তা হলে সেই আত্মাবমাননার ক্ষোভে উর্মিকে মুহুর্তে মুহুর্তে জ্বালিয়ে মারবেন। এ দিকে মথুরের সঙ্গে সমস্ত হিসেবপত্র শোধ করতে গিয়ে শশাঙ্ক হঠাৎ জানতে পেরেছে যে শর্মিলার সমস্ত টাকা ডুবেছে তার ব্যবসায়ে। এ কথা শৰ্মিলা এত দিন তাকে জানায় নি, মিটমাট করে নিয়েছিল মথুরের সঙ্গে । শশাঙ্কের মনে পড়ল, চাকরির অন্তে সে একদিন শর্মিলার টাকা ধার নিয়েই গড়ে তুলেছিল তার ব্যাবসা । আজ নষ্ট ব্যাবসার অন্তে সেই শামিলারই ঋণ মাথায় করে চলেছে সে চাকরিতে । এ ঋণ তো আর নামাতে পারবে না । চাকরির মাইনে দিয়ে কোনো কালে শোধ হবার রাস্তা কই । আর দিন-দশেক বাকি আছে নেপাল-যাত্রার । সমস্ত রাত ঘুমোতে পারে নি। ভোরবেলায় শশাঙ্ক ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠেই আয়নার টেবিলের উপরে হঠাৎ সবলে মুষ্টিঘাত করে বলে উঠল, “যাব না নেপােল।” দৃঢ় পণ করলে, “আমরা দুজনে উর্মিকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকিব- ভুকুটিকুটিল সমাজের ক্রুর দৃষ্টির সামনেই। আর, এইখানেই ভাঙা ব্যাবসাকে আর-একবার গড়ে তুলব। এই কলকাতাতেই বসে ।” যে-যে জিনিস সঙ্গে যাবে, যা রেখে যেতে হবে, শমিলা বসে বসে তারই ফর্দ করছিল একটা খাতায় । ডাক শুনতে পেলে, “শমিলা ! শৰ্মিলা ।” তাড়াতাড়ি খাতা ফেলে ছুটে গেল স্বামীর ঘরে । অকস্মাৎ অনিষ্টের আশঙ্কা করে কম্পিতহীদয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে।” বললে, “যাব না নেপালে । গ্রাহ্য করব না। সমাজকে । থাকব। এইখানেই ।” শমিলা জিজ্ঞাসা করলে, “কেন, কী হয়েছে।” শশাঙ্ক বললে, “কাজ আছে।” সেই পুরাতন কথা— কাজ আছে। শৰ্মিলার বুক দুরুদুরু করে উঠল । “শমি, ভেবো না। আমি কাপুরুষ । দায়িত্ব ফেলে পালাব আমি, এত অধঃপতন কল্পনা করতেও পাের ?” শৰ্মিলা কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললে, “কী হয়েছে আমাকে বুঝিয়ে বলে ।” । শশাঙ্ক বললে, “আবার ঋণ করেছি। তোমার কাছে, সে কথা ঢাকা দিয়ে না ।” শমিলা বললে, “আচ্ছা, বেশ ।” শশাঙ্ক বললে, “সেইদিনকার মতোই আজ থেকে আবার ঋণ শোধ করতে বসলুম। যা ডুবিয়েছি আবার তাকে টেনে তুলিবই এই রইল কথা, শুনে রাখো। একদিন যেমন তুমি আমাকে বিশ্বাস শৰ্মিলা স্বামীর বুকের উপর মাথা রেখে বললে, “তুমিও আমাকে বিশ্বাস কোরো। কাজ বুঝিয়ে