পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মালঞ্চ 8Ꮔ Ꭹ রমেন বললে, “তখন কি কোনো সরলা কোথাও ছিল । অন্তত আমি তাকে জানতুম না । আমার কাছে এখনকার সরলাই একমাত্র সত্য । তুলনা করব কিসের সঙ্গে ।” নীরজা বললে, “ওর এখনকার চেহারা হািদয়ের কোনো একটা রহস্যে ঘন হয়ে ভরে উঠেছে- যেন যে মেঘ ছিল সাদা তার ভিতর থেকে শ্রাবণের জল আজ ঝরি-ঝরি করছে- একেই তোমরা রোম্যান্টিক বল, না ঠাকুরপো ?” সরলা চলে যেতে উদ্যত হল, নীরজা তাকে বললে, “সরলা, একটু বোসো । ঠাকুরপো, একবার পুরুষমানুষের চােখ দিয়ে সরলকে দেখে নিই। ওর কী সকলের আগে চােখে পড়ে বলে দেখি ” রমেন বললে, “সমস্তটাই একসঙ্গে ।” “নিশ্চয়ই ওর চোখ দুটাে ; কেমন একরকম গভীর করে চাইতে জানে। না, উঠে না। সরলা । আর-একটু বোসো। ওর দেহটাও কেমন নিরেট নিটােল।” । “তুমি কি ওকে নিলেম করতে বসেছ নাকি বউদি। জােনই তাে অমনিতেই আমার উৎসাহের কিছু কমতি নেই ।” নীরজা দালালির উৎসাহে বলে উঠল, “ঠাকুরপো, দেখো সরলার হাত দুখানি, যেমন জোরালো। তেমনি সুডোল, কোমল, তেমনি তার শ্ৰী । এমনটি আর দেখেছ ?” রমেন হেসে বললে, “আর কোথাও দেখেছি কি না তার উত্তরটা তোমার মুখের সামনে রূঢ় শোনাবে ।” “আমন-দুটি হাতের পরে দাবি করবে না ?” “চিরদিনের দাবি নাই করলেম, ক্ষণে ক্ষণে দাবি করে থাকি । তোমাদের ঘরে যখন চা খেতে আসি । তখন চায়ের চেয়ে বেশি কিছু পাই ঐ হাতের গুণে। সেই রাসগ্রহণে পাণিগ্রহণের যেটুকু সম্পর্ক থাকে অভাগার পক্ষে সে-ই যথেষ্ট ।” সরলা মোড়া ছেড়ে উঠে পড়ল । ঘর থেকে বেরবার উপক্রম করতেই রমেন দ্বার আগলে বললে, “একটা কথা দাও, তবে পথ ছাড়ব ।” "र्दी, दंब्ली ।” “আজ শুক্লাচতুৰ্দশী । আমি মুসাফির আসব তোমার বাগিচায়, কথা যদি থাকে। তবু কাইবার দরকারই হবে না । আকাল পড়েছে, পেট ভরে দেখাই জোটে না । হঠাৎ এই ঘরে মুষ্টিভিক্ষার দেখাএ মঞ্জুর নয়। আজ তোমাদের গাছতলায় বেশ একটু রয়ে-সয়ে মনটা ভরিয়ে নিতে চাই।” সরলা সহজ সুরেই বললে, “আচ্ছা, এসো তুমি।” রমেন খাটের কাছে ফিরে এসে বললে, “তবে আসি বাউদি ।” “আর থাকবার দরকার কী। বউদির যে কাজটুকু ছিল, সে তো সারা হল ।” রমেন চলে গেল । 8 রমেন চলে গেলে নীরজ হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বিছানায় পড়ে রইল। ভাবতে লাগল, এমন মন-মাতানো দিন তারও ছিল । কত বসন্তের রাতকে সে উতলা করেছে। সংসারের বারো-আনা মেয়ের মতো সে কি ছিল স্বামীর ঘরকন্নার আসবাব। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবলই মনে পড়ে, কতদিন তার স্বামী তার অলক ধরে টেনে আৰ্দ্ৰকণ্ঠে বলেছে, “আমার রঙমহলের সাকী।” দশ বছরে রঙ একটু স্নান হয় নি, পেয়ালা ছিল ভরা। তার স্বামী তাকে বলত, “সেকালে মেয়েদের পায়ের ছোয়া লেগে ফুল ধরত অশোকে, মুখমদের ছিটে পেলে বকুল উঠত ফুটে, আমার বাগানে সেই কালিদাসের কাল দিয়েছে ধরা। যে-পথেরোজ তোমার পা পড়ে, তারই দু’ধারে ফুল ফুটেছে রঙে রঙে, বসন্তের হাওয়ায় দিয়েছ মদ ছড়িয়ে, গোলাপবনে লেগেছে তার নেশা ।” কথায় কথায় সে বলত, “তুমি না থাকলে এই ফুলের স্বর্গে বেনের দোকান বৃত্ৰাসুর হয়ে দখল জমাত। আমার ভাগ্যগুণে তুমি আছ নন্দনবনের