পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳԵր রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আর-কারু প্ৰাণ তার মধ্যে চালিয়ে দেবার জন্যে। আমার ঐ বাগান কি আমার দেহ নয়। আমি হলে কি এমন করতে পারতুম ||” “কী করতে তুমি ।” - “বলব। কী করতুম ? বাগান ছারখার হয়ে যেত হয়তো । ব্যাবসা হত দেউলে । একটার জায়গায় দশটা মালী রাখতুম, কিন্তু আসতে দিতুম না। আর কোনো মেয়েকে, বিশেষত এমন কাউকে যার মনে গুমার আছে- সে আমার চেয়েও বাগানের কাজ ভালো জানে। ওর এই অহংকার দিয়ে তুমি আমাকে অপমান করবে। প্রতিদিন, যখন আমি আজ মরতে বসেছি, যখন উপায় নেই নিজের শক্তি প্ৰমাণ করবার ? এমনটা কেন হতে পারল, বলব ?” יין זףס)a" “তুমি আমার চেয়ে ওকে ভালোবাস বলে। এতদিন সে কথা লুকিয়ে রেখেছিলে ।” আদিত্য কিছুক্ষণ মাথার চুলের মধ্যে হাত গুজে বসে রইল। তার পরে বিহবলকণ্ঠে বললে, “নীরু, দশ বৎসর তুমি আমাকে জেনেছ, সুখে দুঃখে নানা অবস্থায় নানা কাজে, তার পরেও তুমি যদি এমন কথা আজ বলতে পাের তবে আমি কোনো জবাব করব না। চললুম। কাছে থাকলে তোমার শরীর খারাপ হবে । ফর্নারির পাশে যে জাপানি ঘর আছে সেইখানে থাকব । যখন আমাকে দরকার হবে ডেকে পাঠিয়ো ।” ሓdዶ' G দিঘির ও পারের পাড়িতে চালতা গাছের আড়ালে চাদ উঠছে, জলে পড়েছে ঘন কালো ছায়া । এ পারে বাসন্তী গাছে কচি পাতা শিশুর ঘুমভাঙা চোখের মতো রাঙা, তার কঁচাসোনার বরন ফুল, ঘন গন্ধ ভারী হয়ে জমে উঠেছে, গন্ধের কুয়াশা যেন । জোনাকির দল ঝলমল করছে জারুল গাছের ডালে । শান-বাধানো ঘাটের বেদির উপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সরলা । বাতাস নেই কোথাও, পাতায় নেই কঁপনি, জল যেন কালো ছায়ার ফ্রেমে বাধানো পালিশ-করা রুপোর আয়না । পিছনের দিক থেকে প্রশ্ন এল, “আসতে পারি কি ৷” সরলা স্নিগ্ধ কণ্ঠে উত্তর দিলে, “এসো।” রমেন বসিল ঘাটের সিঁড়ির উপর, পায়ের কাছে। সরলা ব্যস্ত হয়ে বললে, “কোথায় বসলে রমেনদাদা, উপরে এসো ।” রমেন বললে, “জান দেবীদের বর্ণনা আরম্ভ পদপল্লব থেকে ? পাশে জায়গা থাকে তো পরে বসব । দাও তোমার হাতখানি, অভ্যর্থনা শুরু করি বিলিতি মতে ।” সরলার হাত নিয়ে চুম্বন করলে। বললে, “সম্রাজ্ঞীর অভিবাদন গ্রহণ করো ।” তার পরে উঠে দাড়িয়ে অল্প একটুখানি আবির নিয়ে দিলে ওর কপালে মাখিয়ে । “এ আবার কী ।” “জন না। আজ দোলপূর্ণিমা ? তোমাদের গাছে গাছে ডালে ডালে রঙের ছড়াছড়ি । বসন্তে মানুষের গায়ে তো রঙ লাগে না, লাগে তার মনে । সেই রঙটাকে বাইরে প্রকাশ করতে হবে, নইলে, বনলক্ষ্মী, অশোকবনে তুমি নির্বাসিত হয়ে থাকবে।” “তোমার সঙ্গে কথার খেলা করি এমন ওস্তাদি নেই। আমার ।” “কথার দরকার কিসের । পুরুষ পাখিই গান করে, তোমরা মেয়ে পাখি চুপ করে শুনলেই উত্তর দেওয়া হল । এইবার বসতে দাও পাশে ।” পাশে এসে বসল। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দুজনেই। হঠাৎ সরলা প্রশ্ন করলে, “রমেনদা, জেলে যাওয়া যায় কী করে, পরামর্শ দাও আমাকে ৷” “জেলে যাবার রাস্তা এত অসংখ্য এবং আজকাল এত সহজ যে কী করে জেলে না যাওয়া যায় সেই পরামর্শই কঠিন হয়ে উঠল। এ যুগে গোরার বাঁশি ঘরে টিকতে দিল না।” “না, আমি ঠাট্টা করছি নে, অনেক ভেবে দেখলুম। আমার মুক্তি ঐখানেই ।” ।