পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ळ् , 8br(፩ “বউদি, একটা কথা বলি শোনো । যতক্ষণ মনে করবে তোমার ধন কেউ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ বুকের পােজর জ্বলবে আগুনে | পাবে না। শান্তি । কিন্তু স্থির হয়ে বসে বলো দেখি একবার“দিলেম আমি । সকলের চেয়ে যা দুর্মুল্য তাই দিলেম তীকে র্যাকে সকলের চেয়ে ভালোবাসি’- সব ভার যাবে একমুহূর্তে নেমে । মন ভরে উঠবে আনন্দে । গুরুকে দরকার নেই ; এখনই বলো“দিলেম, দিলেম, কিছুই হাতে রাখলেম না, আমার সাব-কিছুই দিলেম, নির্মুক্ত হয়ে নির্মল হয়ে যাবার জন্যে প্ৰস্তুত হলেম, কোনো দুঃখের গ্রন্থি জড়িয়ে রেখে গেলেম না সংসারে ।” “আহা, বলো, বলো ঠাকুরপো, বার বার করে শোনাও আমাকে । তাকে এ পর্যন্ত যা-কিছু দিতে পেরেছি। তাতেই পেয়েছি আনন্দ, আজ যা দিতে পারছি নে, তাতেই এত করে মােরছে। দেব, দেব, দেব, সব দেব আমার— আর দেরি নয়, এখনই। তুমি তাকে ডেকে নিয়ে এসো ।” “আজ নয়। বউদি, কিছুদিন ধরে মনটাকে বেঁধে নাও, সহজ হােক তোমার সংকল্প ।” “না, না, আর সইতে পারছি নে । যখন থেকে বলে গেছেন এ বাড়ি ছেড়ে জাপানি ঘরে গিয়ে থাকবেন তখন থেকে এ শয্যা আমার কাছে চিতাশয্যা হয়ে উঠেছে। যদি ফিরে না আসেন এ রাত্তির কাটবে না, বুক ফেটে মরে যাব। আমনি ডেকে এনাে সরলকে, আমি শেল উপড়ে ফেলব বুকের থেকে, ভয় পাব না- এই তোমাকে বলছি নিশ্চয় করে ।” “সময় যায় পাছে এই ভয় । এক্ষনি ডেকে আনাে।” পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে দু হাত জোড় করে বললে, “বল দাও ঠাকুর, বল দাও, মুক্তি দাও মতিহীন অধম নারীকে । আমার দুঃখ আমার ভগবানকে ঠেকিয়ে রেখেছে, পূজা অৰ্চনা সব গেল আমার । ঠাকুরপো, একটা কথা বলি, । আপত্তি কোরো না ।” “কী বলে ।” * ‘ “একবার আমাকে ঠাকুরঘরে যেতে দাও দশ মিনিটের জন্যে, তা হলে আমি বল পাব, কোনো ভয় থাকবে না ।” “আচ্ছা, যাও, আপত্তি করব না ।” “আয়া !” “কী খোখী ।” “সে কী কথা । ডাক্তারবাবু-” "ডাক্তারবাবু যমকে ঠেকাতে পারবে না। আর আমার ঠাকুরকে ঠেকাবে ?” । "আয়া, তুমি ওঁকে নিয়ে যাও, ভয় নেই, ভালোই হবে।” আয়াকে অবলম্বন করে নীরজা যখন চলে গেল এমন সময়ে আদিত্য ঘরে এল । আদিত্য জিজ্ঞাসা করলে, “এ কী, নীরু ঘরে নেই কেন ।” “এখনই আসবেন, তিনি ঠাকুরঘরে গেছেন।” "ঠাকুরঘরে ! ঘর তো কাছে নয়। ডাক্তারের নিষেধ আছে যে ।” “শুনো না দাদা। ডাক্তারের ওষুধের চেয়ে কাজে লাগবে। একবার কেবল ফুলের অঞ্জলি দিয়ে প্ৰণাম করেই চলে আসবেন ।” নীরজাকে চিঠি লিখে যখন পাঠিয়ে দিয়েছিল তখন আদিত্য স্পষ্ট জানত না যে, অদৃষ্ট তার জীবনের পটে প্রথম যে-লিপিখনি অদৃশ্য কালিতে লিখে রেখেছে, বাইরের তাপ লেগে সেটা হঠাৎ এতখানি উঠবে উজ্জ্বল হয়ে। প্রথম ও সরলাকে বলতে এসেছিল- আর উপায় নেই, ছাড়াছড়ি করতে হবে। সেই কথা বলবার বেলাতেই ওর মুখ দিয়ে বেরল উলটাে কথা। তার পরে জ্যোৎ মারাত্রে ঘাটে বসে বসে বার বার করে বলেছে- জীবনের সত্যকে আবিষ্কার করেছে বিলম্বে, তাই বলেই তাকে অস্বীকার করতে পারে না। ওর তো অপরাধ নেই, লজ্জা করবার নেই কিছু।