পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

平研3 8brዒ সরলকে নিয়ে রমেন ঘরে ঢুকল। নীরজা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সরলা প্ৰণাম করলে মীরজার পা ছয়ে। নীরজা বললে, “এসো বোন, আমার কাছে এসো।” সরলার হাত ধরে বিছানায় বসাল। বালিশের নীচে থেকে গয়নার কেস টেনে নিয়ে একটি মুক্তোর মালা বের করে সরলাকে পরিয়ে দিলে। বললে, “একদিন ইচ্ছে করেছিলুম, যখন চিতায় আমার দাহ হবে এই মালাটি যেন আমার গলায় থাকে। কিন্তু তার চেয়ে এই ভালো। আমার হয়ে মালা তুমিই গলায় পরে থেকে শেষদিন পর্যন্ত । বিশেষ বিশেষ দিনে এ মালা কতবার পরেছি। সে তোমার দাদা জানেন । তোমার গলায় থাকলে সেই দিনগুলি ওঁর মনে পড়বে।” “অযোগ্য আমি দিদি, অযোগ্য, কেন আমাকে লজা দিচ্ছি।” নীরজা মনে করেছিল, আজ তার সর্বদানযজ্ঞের এও একটা অঙ্গ। কিন্তু তার অন্তরতর মনের জ্বালা যে এই দানের মধ্যে দীপ্ত হয়ে প্রকাশ পেল সে কথা নিজেও স্পষ্ট বুঝতে পারে নি। ব্যাপারটা সরলাকে যে কতখানি বাজল তা অনুভব করলে আদিত্য । বললে, “ঐ মালাটা আমাকে দাও-না সরলা । ওর মূল্য আমার কাছে যতখানি, এমন আর কারও কাছে নয় । ও আমি আর কাউকে দিতে পারব না ।” । নীরজা বললে, “আমার কপাল। এত করেও বোঝাতে পারলুম না বুঝি । সরলা, শুনেছিলেম। এই বাগান থেকে তোমার চলে যাবার কথা হয়েছিল । সে আমি কোনোমতেই ঘটতে দেব না । তোমাকে আমি আমার সংসারের যা-কিছু সমস্তর সঙ্গে রাখব বেঁধে, এই হারটি তারই চিহ্ন । এই আমার বঁাধন তোমার হাতে দিয়েছিলুম। যাতে নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারি।” “ভুল করছি দিদি, আমাকে বাধতে চেয়ে না, ভালো হবে না। তাতে ।” “সে কী কথা ।” “আমি সত্যি কথাই বলব। এতদিন আমাকে বিশ্বাস করতে পারতে । কিন্তু আজ আমাকে বিশ্বাস কোরো না, এই আমি তোমাদের সকলের সামনেই বলছি। ভাগ্য যে-দান থেকে আমাকে বঞ্চনা করেছে, কাউকে বঞ্চনা করে সে আমি নেব না । এই রইল তোমার পায়ে আমার প্রণাম, আমি চললেম । অপরাধ আমার নয়, অপরাধ সেই আমার ঠাকুরের র্যাকে সরল বিশ্বাসে রোজ দু বেলা পূজা করেছি। সেও আজ আমার শেষ হল ।” এই বলে সরলা দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । আদিত্য নিজেকে ধরে রাখতে পারলে না, সেও গেল চলে । “ঠাকুরপো, এ কী হল। ঠাকুরপো । বলো ঠাকুরপো, একটা কথা কও ” “এইজন্যেই বলেছিলেম আজ রাত্রে ডেকো না ।” "কেন, মন খুলে আমি তো সবই দিয়ে দিয়েছি। ও কি তাও বুঝল না।” "বুঝেছে বৈকি। বুঝেছে যে, মন তোমার খোলে নি। সুর বাজল না।” । "কিছুতে বিশুদ্ধ হল না। আমার মন ! এত মার খেয়েও ! কে বিশুদ্ধ করে দেবে। ওগো সন্ন্যাসী, আমাকে বীচাও-না। ঠাকুরপো, কে আমার আছে, কার কাছে যাব আমি।” "আমি আছি বউদি। তোমার দায় আমি নেব । তুমি এখন ঘুমোও ।” "ঘুমোব কেমন করে। এ বাড়ি থেকে আবার যদি উনি চলে যান তা হলে মরণ নইলে আমার ঘুম হবে না ।” "চলে উনি যেতে পারবেন না ; সে ওঁর ইচ্ছায় নেই, শক্তিতে নেই। এই নাও ঘুমের ওষুধ, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আমি যাব।” “যাও ঠাকুরপাে, তুমি যাও, ওরা দুজনে কোথায় গেল দেখে এসো, নইলে আমি নিজেই যাব, তাতে আমার শরীর ভাঙে ভাঙুক।” "আচ্ছা, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।”