পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

व्3 8ՀV9 আদিত্যকে বলতে হল, “হা, মনে করব।” কিন্তু এমন সুরে বলতে পারলে না যাতে তার বিশ্বাসের প্রমাণ হয় । নীরজা অস্থির হয়ে বলে উঠল, “তোমাদের বই যারা লেখে ভারি তো পণ্ডিত তারা, কিছু জানে না। আমি নিশ্চয় জানি, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি থাকিব, আমি এইখানেই থাকিব, আমি তোমারই কাছে থাকিব, একেবারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই তোমাকে বলে যাচ্ছি, কথা দিয়ে যাচ্ছি, তোমার বাগানের গাছপালা সমস্তই আমি দেখব, যেমন আগে দেখতুম তার চেয়ে অনেক ভালো করে দেখব। কাউকে দরকার হবে না। কাউকে না।” বিছানায় শুয়ে ছিল নীরজা ; উঠে বালিশে ঠেসান দিয়ে বসল, বললে, “আমাকে দয়া কোরো, দয়া কোরো। তোমাকে এত ভালোবাসি সেই কথা মনে করে আমাকে দয়া কোরো। এতদিন তুমি আমাকে যেমন আদরে স্থান দিয়েছ তোমার ঘরে, সেদিনও তেমনি করেই স্থান দিয়ে । ঋতুতে ঋতুতে তোমার যে-সব ফুল ফুটবে তেমনি করেই মনে মনে তুলে দিয়ে আমার হাতে। যদি নিষ্ঠুর হও তুমি, তা হলে তো এখানে আমি থাকতে পারব না । আমার বাগান যদি কেড়ে নাও তা হলে হাওয়ায় হাওয়ায় কোন শূন্যে আমি ভেসে বেড়াব’ ?” নীরজার দুই চক্ষু দিয়ে জল ঝরে পড়তে লািগল । । আদিত্য মোড়া ছেড়ে বিছানার উপর উঠে বসিল । নীরজার মুখ বুকে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলোতে লাগল তার মাথায় । বললে, “নীরু, শরীর নষ্ট কোরো না।” “যাক গে। আমার শরীর। আমি আর কিছু চাই নে, আমি কেবল তোমাকে চাই এই সমস্ত-কিছু নিয়ে । শোনো একটা কথা বলি, রাগ কোরো না। আমার উপর, রাগ কোরো না” বলতে বলতে স্বর রুদ্ধ হয়ে এল। একটু শান্ত হলে পর বললে, “সরলার উপর অন্যায় করেছি। তোমার পায়ে ধরে । বলছি আর অন্যায় করব না । যা হয়েছে, তার জন্যে আমাকে মাপ কোরো । কিন্তু আমাকে ভালোবেসো, ভালোবেসো তুমি, যা চাও আমি সব করব।” আদিত্য বললে, “শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মন ছিল অসুস্থ নীরু, তাই নিজেকে মিথ্যা পীড়ন করেছ।” “শোনো বলি। কালি রাত্রি থেকে বার বার পণ করেছি, এবার দেখা হলে নির্মল মনে ওকে বুকে টেনে নেব আপন বোনের মতো । তুমি আমাকে এই শেষ প্রতিজ্ঞা-রক্ষায় সাহায্য করো। বলো, আমি তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হব না, তা হলে সবাইকে আমার ভালোবাসা দিয়ে যেতে পারব ।” এ কথার কোনো উত্তর না করে আদিত্য বার বার চুম্বন করলে ওর মুখ, ওর কপাল। মুদে এল নীরজার চোখ। খানিক বাদে নীরজা জিজ্ঞাসা করলে, “সরলা কবে খালাস পাবে সেই দিন গুনছি। ভয় হয়। পাছে তার আগে মরে যাই । পাছে বলে যেতে না পারি যে আমার মন একেবারে সাদা হয়ে গৈছে | এইবার আলো জ্বালাও । আমাকে পড়ে শোনাও অক্ষয় বড়ালের “এষা ।” বালিশের নীচে থেকে বই বের করে দিলে। আদিত্য পড়ে শোনাতে লাগল। শুনতে শুনতে যেই একটু ঘুম এসেছে আয়া। ঘরে এসে বলল, “চিঠি”, ঘোর ভেঙে নীরজা চমকে উঠল । ধড় ধড় করতে লাগল তার বুক। কোনাে বন্ধু আদিত্যকে খবর দিয়েছে, জেলে স্থানাভাব, তাই যে-কয়টি কয়েদীকে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই ছেড়ে দেওয়া হবে সরলা তার মধ্যে একজন । আদিত্যের মনটা লাফিয়ে উঠল । প্রাণপণ বলে চেপে রাখলে মনের উল্লাস । নীরজা জিজ্ঞাসা করলে, "কার চিঠি, কী খবর ।” পাছে পড়তে গেলে গলার আওয়াজ যায়৷ কেঁপে, চিঠিখানা দিলে নীরজার হাতেই । নীরজা আদিত্যের মুখের দিকে চাইলে । মুখে কথা নেই বটে কিন্তু কথার প্রয়োজন ছিল না । নীরজার মুখেও কথা বেরল না কিছুক্ষণ। তার পরে খুব জোর করে বললে, “তা হলে তাে আর দেরি নেই। আজই আঁসবে । নিশ্চয়ই ওকে আনবে আমার কাছে ।”

  • ও কী । কী হল । নীরু ! নার্স, ডাক্তার আছেন ?”

"আছেন বাইরের ঘরে ।”