পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী “এখনই নিয়ে এসো, এই যে ডাক্তার ! এইমাত্র বেশ সহজ শরীরে কথা বলছিল, বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গেল ।” । ডাক্তার নাড়ী দেখে চুপ করে রইল । কিছুক্ষণ পরে রোগী চোখ মেলেই বললে, “ডাক্তার, আমাকে বাচাতেই হবে । সরলাকে না দেখে যেতে পারব না, ভালো হবে না। তাতে । আশীর্বাদ করব তাকে- শেষ আশীৰ্বাদ ।” আবার এল চােখ বুজে। হাতের মুঠো শক্ত হল, বলে উঠল, “ঠাকুরপো, কথা রাখব, কৃপণের মতো মরব না ।” এক-একবার চেতনা ক্ষীণ হয়ে জগৎ ঝাপসা হয়ে আসছে, আবার নিবু-নিবু প্ৰদীপের মতো জীবন-শিখা উঠছে জ্বলে । স্বামীকে থেকে থেকে জিজ্ঞাসা করছে, “কখন আসবে সরলা ৷” থেকে থেকে সে ডেকে ওঠে, “ রোশনি !” আয়া বলে, “কী খোখী ।” Ħ “ঠাকুরপোকে ডেকে দে এক্ষুনি ।” একবার আপনি বলে উঠল, “কী হবে আমার ঠাকুরপো ! দেব দেব দেব, সব দেব ।” রাত্রি তখন নটা । নীরজার ঘরের কোণে ক্ষীণ আলোতে জ্বলছে একটা মোমের বাতি । বাতাসে দোলনচাঁপার গন্ধ । খোলা জানলার থেকে দেখা যায় বাগানের গাছগুলোর পুঞ্জীভূত কালিমা, আর তার উপরের আকাশে কালপুরুষের নক্ষত্ৰশ্রেণী । রোগী ঘুমোচ্ছে। আশঙ্কা ক’রে সরলাকে দরজার কাছে রেখে আদিত্য ধীরে ধীরে এল নীরজার বিছানার কাছে । আদিত্য দেখলে ঠোট নড়ছে। যেন নিঃশব্দে কী জপ করছে। জ্ঞানে অজ্ঞানে জড়িত বিহবল মুখ । কানের কাছে মাথা নামিয়ে আদিত্য বললে, “সরলা এসেছে।” চোখ ঈষৎ মেলে নীরজা বললে, “তুমি যাও”- একবার ডেকে উঠল, “ঠাকুরপো !” কোথাও সাড়া নেই। সরলা এসে প্ৰণাম করবার জন্য পায়ে হাত দিতেই যেন বিদ্যুতের আঘাতে ওর সমস্ত শরীর আক্ষিপ্ত হয়ে উঠল । পা দ্রুত আপনি গেল সরে । ভাঙা গলায় বলে উঠল, “পারলুম না, পারলুম না, দিতে পারব না, পারব না।” বলতে বলতে অস্বাভাবিক জোর এল দেহে- চোখের তারা প্রসারিত হয়ে জ্বলতে লাগল। চেপে ধরলে সরলার হাত, কণ্ঠস্বর তীক্ষা হল, বললে, “জায়গা হবে না তোর রাক্ষসী, জায়গা হবে না । আমি থাকিব, থাকিব, থাকব ।” হঠাৎ ঢ়িলে-শেমিজ-পরা পাণ্ডুবৰ্ণ শীৰ্ণমূর্তি বিছানা ছেড়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। অদ্ভুত গলায় বললে, “পালা পালা পালা এখনই, নইলে দিনে দিনে শেল বিধব তাের বুকে, শুকিয়ে ফেলব তোর রক্ত ৷” বলেই পড়ে গেল মেঝের উপর । , গলার শব্দ শুনে আদিত্য ছুটে এল ঘরে, প্রাণের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে ফেলে দিয়ে নীরজার শেষ কথা তখন স্তব্ধ হয়ে গেছে । ]