পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

のの、 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অহংকার, পরস্পরের মধ্যে অনর্থক ব্যবধানের সৃষ্টি করা হয়। এই পবিত্রতার দোহাই দিয়ে এই বিজাতীয় মানবঘুণা আমাদের চরিত্রের মধ্যে যে কীটের ন্যায় কাৰ্য করে তা অনেকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা অম্লানমুখে বলেন, কই, আমরা ঘূণা কই করি ! আমাদের শাস্ত্ৰেই যে আছে বসুধৈব কুটুম্বকম। শাস্ত্রে কী আছে এবং বুদ্ধিমানের ব্যাখ্যায় কী দাড়ায় তা বিচাৰ্য নয়, কিন্তু আচরণে কী প্রকাশ পায় এবং সে আচরণের আদিম কারণ যাই থাক তার থেকে সাধারণের চিত্তে স্বভাবতই মানবঘুণার উৎপত্তি হয় কি না, এবং কোনো-একটি জাতির আপামর সাধারণে অপর সমস্ত জাতিকে নির্বিচারে ঘূণা করবার অধিকারী কি না, তাই বিবেচনা করে দেখতে হবে। আর-একটি কথা, জড়পদার্থই বাহ্য মলিনতায় কলঙ্কিত হয়। শখের পোশাকটি পরে যখন বেড়াই তখন অতি সন্তপণে চলতে হয়। পাছে ধুলো লাগে, জল লাগে, কোনোরকম দাগ লাগে, অনেক সাবধানে আসন গ্রহণ করতে হয়। পবিত্রতা যদি পোশাক হয় তবেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় পাছে এর ছোওয়া লাগলে কালো হয়ে যায়, ওর হাওয়া লাগলে চিহ্ন পড়ে। এমন একটি পোশাকি পবিত্ৰতা নিয়ে সংসারে বাস করা কী বিষম বিপদ । জনসমাজের রণক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে এবং রঙ্গভূমিতে ঐ অতি পরিপটি পবিত্রতাকে সামলে চলা অত্যন্ত কঠিন হয় বলে শুচিবায়ুগ্ৰস্ত দুৰ্ভাগা জীব আপন বিচরণ-ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ করে আনে, আপনাকে কাপড়টা-চোপড়টার মতো সর্বদা সিন্দুকের মধ্যে তুলে রাখে, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ কখনোই তার দ্বারা সম্ভব হয় না। আত্মার আন্তরিক পবিত্রতার প্রভাবে বাহ্য মলিনতাকে কিয়ৎপরিমাণে উপেক্ষা না করলে চলে না । অত্যন্ত রূপপ্ৰয়াসী ব্যক্তি বৰ্ণবিকারের ভয়ে পৃথিবীর ধূলামাটি জলরৌদ্র বাতাসকে সর্বদা ভয় করে চলে এবং ননির পুতুলটি হয়ে নিরাপদ স্থানে বিরাজ করে । ভুলে যায় যে, বর্ণসীেকুমাৰ্য সৌন্দর্যের একটি বাহ্য উপাদান, কিন্তু স্বাস্থ্য তার একটি প্রধান আভ্যন্তরিক প্রতিষ্ঠাভূমি— জড়ের পক্ষে এই স্বাস্থ্য অনাবশ্যক, সুতরাং তাকে ঢেকে রাখলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আত্মাকে যদি মৃত জ্ঞান না কর তবে কিয়ৎপরিমাণে মলিনতার আশঙ্কা থাকলেও তার স্বাস্থ্যের উদ্দেশে, তার বল উপার্জনের উদ্দেশে, তাকে সাধারণ জগতের সংস্রবে। আনা আবশ্যক । আধ্যাত্মিক বাবুয়ানা কথাটা কেন ব্যবহার করেছিলুম এইখানে তা বুঝা যাবে। অতিরিক্ত বাহ্যসুখপ্রিয়তাকেই বিলাসিত বলে, তেমনি অতিরিক্ত বাহ্যপবিত্রতাপ্রিয়তাকে আধ্যাত্মিক বিলাসিতা বলে। একটু খাওয়াটি শোওয়াটি বসাটির ইদিক ওদিক হলেই যে সুকুমার পবিত্ৰতা ক্ষুন্ন হয় তা বাবুয়ানার অঙ্গ। এবং সকলপ্রকার বাবুয়ানাই মনুষ্যত্বের বলবীৰ্যনাশক । সংকীর্ণতা এবং নিজীবতা অনেকটা পরিমাণে নিরাপদ সে কথা অস্বীকার করা যায় না । যে সমাজে মানবপ্রকৃতির সম্যক স্মৃর্তি এবং জীবনের প্রবাহ আছে সে সমাজকে বিস্তর উপদ্রব সইতে হয়, সে কথা সত্য । যেখানে জীবন অধিক সেখানে স্বাধীনতা অধিক এবং সেখানে বৈচিত্ৰ্য অধিক । সেখানে ভালো মন্দ দুই প্রবল। যদি মানুষের নখদন্ত উৎপাটন করে আহার কমিয়ে দিয়ে দুই বেলা চাবুকের ভয় দেখানো হয় তা হলে একদল চলৎশক্তিরহিত অতিনিরীহ পোষা প্রাণীর সৃষ্টি হয়, জীবস্বভাবের বৈচিত্র্য একেবারে লোপ হয় ; দেখে বোধ হয় ভগবান এই পৃথিবীকে একটা প্ৰকাণ্ড পিঞ্জাররূপে নির্মাণ করেছেন, জীবের আবাসভূমি করেন নি । 理 কিন্তু সমাজের যে-সকল প্রাচীন ধাত্রী আছেন তারা মনে করেন সুস্থ ছেলে দুরন্ত হয় এবং দুরন্ত ছেলে কখনো কঁাদে, কখনো ছুটােছুটি করে, কখনো বাইরে যেতে চায়, তাকে নিয়ে বিষম ঝঙ্কাট, অতএব তার মুখে কিঞ্চিৎ অহিফেন দিয়ে তাকে যদি মৃতপ্রায় করে রাখা যায় তা হলেই বেশ নির্ভাবনায় গৃহকাৰ্য করা যেতে পারে । । s সমাজ যতই উন্নতি লাভ করে ততই তার দায়িত্ব এবং কর্তব্যের জটিলতা স্বভাবতই বেড়ে উঠতে থাকে। যদি আমরা বলি, আমরা এতটা পেরে উঠব না, আমাদের এত উদ্যম নেই, শক্তি নেই- যদি কিন্তু মানুষের পক্ষে যত সত্বর সম্ভব (এমনকি, অসম্ভব বললেও হয়) আমরা পিতামাতা হতে প্ৰস্তুত