পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሱ S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এ যেন এক শক্রকে তাড়াইবার উদ্দেশ্যে আর-এক শক্রকে ডাকা । মোগলের হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য পাঠানের হাতে আত্মসমর্পণ করা। যাহার নিজের কিছুমাত্র শক্তি আছে, সে এমন বিপদের খেলা খেলিতে চাহে না । আমাদের কি নিজের কোনো শক্তি নাই। আমাদের সমাজে যদি কোনো দোষের সঞ্চার হয়, যদি তাহার কোনো ব্যবস্থা আমাদের সমস্ত জাতির উন্নতিপথের ব্যাঘাত-স্বরূপ আপনি পাষাণমন্তক উত্তোলন করিয়া থাকে, তবে তাহা দূর করিতে গেলে কি আমাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, বহু প্ৰাচীনকালে তাহার কোনো নিষেধবিধি ছিল কি না । যদি দৈবাৎ পাওয়া গেল, তবে দিনকতক পণ্ডিতে পণ্ডিতে শাস্ত্রে শাস্ত্ৰে দেশব্যাপী একটা লাঠালাঠি পড়িয়া গেল ; আর যদি দৈবাৎ অনুস্বারবিসর্গবিশিষ্ট একটা বচনাধর্ধনা পাওয়া গেল, তবে আমরা কি এমনি নিরুপায় যে, সমাজের সমস্ত অসম্পূর্ণতা সমস্ত দোষ শিরোধাৰ্য করিয়া বহন করিব, এমন-কি, তাহাকে পবিত্ৰ বলিয়া পূজা করিব। দোষও কি প্রাচীন হইলে পূজ্য হয়। ' . আমরা কি নিজের কর্তব্য বুদ্ধির বলে মাথা তুলিয়া বলিতে পারি না- পূর্বে কী ছিল এবং এখন কী আছে তাহা জানিতে চাহি না, সমাজের যাহা দোষ তাহা দূর করিব, যাহা মঙ্গল তাহা আবাহন করিয়া আনিব । আমাদের শুভাশুভ জ্ঞানকে হস্তপদ ছেদন করিয়া পঙ্গু করিয়া রাখিয়া দিব, আর একটা গুরুতর আবশ্যক পড়িলে, দেশের একটা মহৎ অনিষ্ট একটা বৃদ্ধ অকল্যাণ দূর করিতে হইলে, সমস্ত পুরাণসংহিতা আগম-নিগম হইতে বচনখণ্ড খুঁজিয়া খুঁজিয়া উদভ্ৰান্ত হইতে হইবে- সমাজের হিতাহিত লইয়া বয়স্ক লোকের মধ্যে এরূপ বাল্য খেলা আর কোনো দেশে প্রচলিত আছে কি । আমাদের ধর্মবুদ্ধিকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া যে-লোকাচারকে তাহার স্থলে অভিষিক্ত করিয়াছি, সে আবার এমনি মূঢ় অন্ধ যে, সে নিজের নিয়মেরও সংগতি রক্ষা করিতে জানে না। কত হিন্দু যবনের জাহাজে চড়িয়া উড়িষ্যা মাদ্রাজ সিংহল ভ্ৰমণ করিয়া আসিতেছে, তাহদের জাতি লইয়া কোনো কথা উঠিতেছে না, এ দিকে সমুদ্রযাত্রা বিধিসংগত নহে বলিয়া লোকসমাজ চীৎকার করিয়া মরিতেছে। দেশে শত শত লোক অখাদ্য ও যবনান্ন খাইয়া মানুষ হইয়া উঠিল, প্রকাশ্যে যবনের প্রস্তুত মদ্য পান করিতেছে, কেহ সে দিকে একবার তাকায়ও না, কিন্তু বিলাতে গিয়া পাছে অনাচার ঘটে এজন্য বড়ো শঙ্কিত। কিন্তু যুক্তি নিস্ফল। যাহার চক্ষু আছে তাহার নিকট এ-সকল কথা চােখে আঙুল দিয়া দেখাইবারও আবশ্যক ছিল না। কিন্তু লোকাচার নামক প্ৰকাণ্ড জড়পুত্তলিকার মস্তকের অভ্যন্তরে তো মস্তিষ্ক নাই, সে একটা নিশ্চল পাষাণমাত্র । কাককে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত গৃহস্থ হাড়ি চিত্রিত করিয়া শস্যক্ষেত্রে খাড়া করিয়া রাখে, লোকাচার সেইরূপ চিত্রিত বিভীষিকা। যে তাহার জড়ত্ব জানে। সে তাহাকে ঘূণা করে, যে তাহাকে ভয় করে তাহার কর্তব্যবৃদ্ধি লোপ পায় । আজকাল অনেক পুস্তক ও পত্রে আমাদের বর্তমান লোকচারের অসংগতিদোষ দেখানো হয় । বলা হয়, এক দিকে আমরা বাধ্য হইয়া অথবা অন্ধ হইয়া কত অনাচার করি, অন্য দিকে সামান্য আচার বিচার লইয়া কত কড়াক্কড় । কিন্তু হাসি পায় যখন ভাবিয়া দেখি, কাহাকে সে-কথাগুলা বলা হইতেছে। শিশুরা পুত্তলিকার সঙ্গেও এমনি করিয়া কথা কয়। কে বলে লোকাচার যুক্তি অথবা শাস্ত্র মানিয়া চলে। সে নিজেও এমন মহা অপরাধ স্বীকার করে না। তবে তাহাকে যুক্তির কথা কেন বলি । সমাজের মধ্যে যে-কোনো পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তাহা বিনা যুক্তিতেই সাধিত হইয়াছে। গুরুগোবিন্দ, চৈতন্য যখন এই জাতিনিগড়িবদ্ধ দেশে জাতিভেদ কথঞ্চিৎ শিথিল করেন, তখন তাহা যুক্তিবলে করেন নাই, চরিত্রবলে করিয়াছিলেন । আমাদের যদি এরাপ মত হয় যে, সমুদ্রযাত্রায় উপকার আছে ; মনুর যে-নিষেধ বিনা কারণে ভারতবষীয়দিগকে চিরকালের জন্য কেবল পৃথিবীর একাংশেই বদ্ধ করিয়া রাখিতে চাহে, সেই কারাদণ্ডবিধান নিতান্ত অন্যায় ও অনিষ্টজনক, দেশে-বিদেশে গিয়া জ্ঞান-অৰ্জন ও উন্নতিসাধন হইতে কোনো প্রাচীন বিধি আমাদিগকে বঞ্চিত করিতে পারে না ; যিনি আমাদিগকে এই সমুদ্রবেষ্টিত পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন, তিনি আমাদিগকে সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণের অধিকার দিয়াছেন- তবে