পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

अभी७ ৫৩৩ চাহি না । কারণ সময়ের পরিবর্তন হইয়াছে, এবং সেই পরিবর্তনের একেবারে বিপরীতমুখে চলিতে গেলে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব হইয়া উঠে । অতএব এ কথা স্বীকার করিতে হইবে যে, বাংলাদেশে যে-ভাবে ধুতি চাদর পরা হয়, তাহা আধুনিক কাজকর্ম এবং আপিস-আদালতের উপযোগী নয়। কিন্তু আচকান-চাপকানের প্রতি সে-দোষারোপ করা যায় না । । সাহেবি বেশধারীরা বলেন, ওটাও তো বিদেশী সাজ । বলেন বটে, কিন্তু সে একটা জেদের তর্ক মাত্র। অর্থাৎ বিদেশী বলিয়া চাপকন তাহারা পরিত্যাগ করেন নাই, সাহেব সাজিবার একটা কোনো বিশেষ প্রলোভন আছে বলিয়াই ত্যাগ করিয়াছেন । । কারণ যদি চাপকন এবং কোট দুটােই তাহার নিকট সমান নূতন হইত, যদি তীহাকে আপিসে প্ৰবেশ ও রেলগাড়িতে পদার্পণ করিবার দিন দুটাের মধ্যে একটা প্রথম বাছিয়া লইতে হইত, তাহা হইলে এ-সকল তর্কের উত্থাপন হইতে পারিত । চাপকন তাহার গায়েই ছিল, তিনি সেটা তাহার পিতার নিকট হইতে পাইয়াছিলেন। তাহা ত্যাগ করিয়া যেদিন কালো কুর্তির মধ্যে প্রবেশপূর্বক গলায় টাই বাধিলেন, সেদিন আনন্দে এবং গৌরবে এ তর্ক তোলেন নাই যে, পিতা ও চাপিকানটা কোথা হইতে পাইয়াছিলেন । তোলাও সহজ নহে, কারণ চপকানের ইতিবৃত্ত ঠিক তিনিও জানেন না, আমিও জানি না । কেননা মুসলমানদের সহিত বসনভূষণ শিল্পসাহিত্যে আমাদের এমন ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান হইয়া গেছে যে, উহার মধ্যে কতটা কার, তাহার সীমা নির্ণয় করা কঠিন । চাপকন হিন্দু মুসলমানের মিলিত বস্ত্র । উহা যে-সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বর্তমান আকারে পরিণত হইয়াছে, তাহাতে হিন্দু মুসলমান উভয়েই সহায়তা করিয়াছে। এখনো পশ্চিমে ভিন্ন ভিন্ন রাজাধিকারে চাপিকানের অনেক বৈচিত্ৰ্য দেখা যায় ; ; সে-বৈচিত্র্যে যে একমাত্র মুসলমানের কর্তৃত্ব তাহা নহে, তাহার মধ্যে হিন্দুরও স্বাধীনতা আছে। যেমন আমাদের ভারতবষীয় সংগীত মুসলমানেরও বটে। হিন্দুরও বটে, তাহাতে উভয়জাতীয় গুণীরই হাত আছে ; যেমন মুসলমান রাজ্যপ্ৰণালীতে হিন্দু মুসলমান উভয়েরই স্বাধীন ঐক্য ছিল। তাহা না হইয়া যায় না। কারণ মুসলমানগণ ভারতবর্ষের অধিবাসী ছিল। তাঁহাদের শিল্পবিলাস ও নীতিপদ্ধতির আদর্শ ভারতবর্ষ হইতে সুদূরে থাকিয়া আপন আদিমত রক্ষা করে নাই ; এবং মুসলমান যেমন বলের দ্বারা ভারতবর্ষকে আপনার করিয়া লইয়াছিল, ভারতবর্ষও তেমনই স্বভাবের অমোঘ নিয়মে কেবল আপনি বিপুলতা আপন নিগৃঢ় প্রাণশক্তি দ্বারা মুসলমানকে আপনার করিয়া লইয়াছিল। চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচিশিল্প, ধাতুদ্ৰব্য-নির্মাণ, দন্তকার্য, নৃত্য, গীত, এবং রাজকাৰ্য, মুসলমানের আমলে ইহার কোনোটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই ; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে । তখন ভারতবর্ষের যে একটি বাহ্যাবরণ নির্মিত হইতেছিল, তাহাতে হিন্দু ও মুসলমান। ভারতবর্ষের ডান হাত ও বাম হাত হইয়া টানা ও পোড়েন বুনিতেছিল । অতএব এই মিশ্রণের মধ্যে চাপকানের খাটি মুসলমানত্ব যিনি গায়ের জোরে প্রমাণ করিতে চান, তাহাকে এই কথা বলিতে হয় যে, তোমার যখন গায়ের এতই জোর, তখন কিছুমাত্র প্রমাণ না করিয়া । এােয়র জােরেই হার্টকােট অবলম্বন করে আমরা মনের আক্ষেপ নীরবে মনের মধ্যে পরিপাক S এক্ষণে যদি ভারতবষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনোমতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। যদি বিধাতার কৃপায় কোনোদিন সহস্ৰ অনৈক্যের দ্বারা খণ্ডিত হিন্দুরা এক হইতে পারে, তবে হিন্দুর সহিত মুসলমানের এক হওয়াও বিচিত্র হইবে না। হিন্দু মুসলমানে ধর্মে না-ও মিলিতে পারে, কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে- আমাদের শিক্ষা আমাদের চেষ্টা । আমাদের মহৎ স্বাৰ্থ সেই দিকে অনবরত কাজ করিতেছে। অতএব যে-বেশ আমাদের জাতীয় বেশ যদি সত্য হয়, চাপকন পায়জামা একমাত্র মুসলমানদেরই উদভাবিত সজা, তথাপি এ কথা যখন