পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७ (*\96. দেখিয়া অন্তত ভদ্র ফিরিঙ্গি বলিয়া লোকে আন্দাজ করিবে— ইংরেজি কায়দা জানে না, এমন মূৰ্ছাকর অপবাদ কেহ দিতে পরিবে না । - ' s কিন্তু পনেরো-আনা বাঙালিরই অর্থাভাব, এবং চান্দনিই তাহাদের বাঙালি সজার চরম মোক্ষস্থান । অতএব উলট-পালটা ভুলচুক হইতেই হইবে। এমন স্থলে পরের সাজ পরিতে গেলে অধিকাংশ লোকেরই সঙসাজা বৈ গতি নাই । স্বজাতিকে কেন এমন করিয়া অপদস্থ করা। এমন কাজ কেন কর, যাহার দৃষ্টান্তে দেশের লোক হাস্যকর হইয়া উঠে। দুই-চারিটা কাক অবস্থাবিশেষে ময়ূরের পুচ্ছ মানান-সই করিয়া পরিতেও পারে, কিন্তু বাকি কাকেরা তাহা কোনোমতেই পরিবে না, কারণ ময়ূরসমাজে তাঁহাদের গতিবিধি নাই, এমন ময়ূরপুচ্ছের লোভ সংবরণ করিতেই হইবে । না। যদি করেন, তবে পরপুচ্ছ বিকৃতভাবে আস্ফালনের প্ৰহসন সর্বত্রই ব্যাপ্ত হইয়া পড়িবে। এই লজা হইতে, ইংরেজিয়ানার এই বিকার হইতে, স্বদেশকে রক্ষা করিবার জন্য আমরা কি সক্ষম । নকলকারীকে সানুনয়ে অনুরোধ করিতে পারি না, কারণ, তাহারা সক্ষম, আর-সকলে অক্ষম । এমন-কি, অবস্থাবিশেষে তাঁহাদের পুত্রপৌত্রেরাও অক্ষম হইয়া পড়িবে। তাহারা যখন ফিরিঙ্গিলীলার অধস্তন রসাতলের গলিতে গলিতে সমাজচ্যুত আবর্জনার মতো পড়িয়া থাকিবে, তখন কি র্যাঙ্কিনবিলাসীর প্ৰেতাত্মা শান্তিলাভ করিবে । দরিদ্র কোনোমতেই পরের নকল ভদ্ররকমে করিতে পারে না । নকল করিবার কাঠখড় বেশি । বাহির হইতে তাহার আয়োজন করিতে হয় । যাহাকে নকল করিতে হইবে, সর্বদা তাহার সংসর্গে থাকিতে হয়, দরিদ্রের পক্ষে সেইটেই সর্বাপেক্ষা কঠিন। সুতরাং সে-অবস্থায় নকল করিতে হইলে, আদর্শভ্ৰষ্ট হইয়া কিন্তুতকিমাকার একটা ব্যাপার হইয়া পড়ে। বাঙালির পক্ষে খাটাে ধুতি পরা লজ্জাকর নহে, কিন্তু খাটাে প্যান্টলুন পরা লজ্জাজনক। কারণ, খাটাে প্যান্টলুনে কেবল অসামর্থ্য বুঝায় না, তাহাতে পর সাজিবার যে-চেষ্টা যে-স্পর্ধা প্রকাশ পায়, তাহা দারিদ্র্যের সহিত কিছুতেই সুসংগত নহে। আজকাল ইংরেজি সাজ কিরূপ চলতি হইয়া আসিতেছে, এবং যতই চলতি হইতেছে ততই তাহা কিরূপ বিকৃত হইয়া উঠিতেছে, দাৰ্জিলিঙের মতো জায়গায় আসিলে অল্পকালের মধ্যেই তাহা অনুভব করা যায়। বাঙালির দূরদৃষ্ট বাঙালিকে অনেক দুঃখ দিয়াছে- পেটে প্লীহা, হাড়ের মধ্যে ম্যালেরিয়া, দেহে কৃশতা, চর্মে কালিমা, ভাণ্ডারে দৈন্য ; অবশেষে তাহাকে কি অদ্ভুত সাজে সাজাইয়া ব্যঙ্গ করিতে আরম্ভ করিবে । চিত্তদীের্বল্যে যখন হাস্যকর করিয়া তোলে, তখন ধারণী দ্বিধা হওয়া ছাড়া লজানিবারণের আর উপায় থাকে না । আচারব্যবহার সাজসজা উদ্ভিদের মতো, তাহাকে উপড়াইয়া আনিলে শুকাইয়া পচিয়া নষ্ট হইয়া যায়। বিলাতি বেশভূষা-আদিবাকায়দার মাটি এখানে কোথায় । সে কোথা হইতে তাহার অভ্যস্ত রস আকর্ষণ করিয়া সজীব থাকিবে । ব্যক্তিবিশেষ খরচপত্র করিয়া কৃত্রিম উপায়ে মাটি আমদানি করিতে পারেন এবং দিনরাত সযত্ন সচেতন থাকিয়া তাহাকে কোনোমতে খাড়া রাখিতে পারেন । কিন্তু সে কেবল দুই-চারিজন শৌখিনের দ্বারাই সাধ্য। যাহাকে পালন করিতে, সজীব রাখিতে পরিবে না, তাহাকে ঘরের মধ্যে আনিয়া পচাইয়া হাওয়া খারাপ করিবার দরকার ? ইহাতে পরেরটাও নষ্ট হয়, নিজেরটাও মাটি হইয়া যায় । সমস্ত মাটি করিবার সেই আয়োজন বাংলাদেশেই দেখিতেছি। - তবে কি পরিবর্তন হইবে না । যেখানে যাহা আছে, চিরকাল কি সেখানে তাহা একই ভাবে চলে । প্রয়োজনের নিয়মে পরিবর্তন হইবে, অনুকরণের নিয়মে নহে। কারণ, অনুকরণ অনেক সময়ই প্রয়োজনবিরুদ্ধ। তাহা সুখশান্তিস্বাস্থ্যের অনুকুল নহে। চতুদিকের অবস্থার সহিত তাহার সামঞ্জস্য নাই । তাহাকে চেষ্টা করিয়া আনিতে হয়, কষ্ট করিয়া রক্ষা করিতে হয় । , অতএব রেলওয়ে-ভ্ৰমণের জন্য, আপিসে বাহির হইবার জন্য, নূতন প্রয়োজনের জন্য ছাঁটা-কাটা