পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○br রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবলমাত্র অনুকরণ এবং সুবিধার আকর্ষণে আত্মসমাজ হইতে র্যাহারা নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিতেছেন, তাহাদের পুত্রপৌত্রেরা তঁহাদের নিকট কৃতজ্ঞ হইবে না, ইহা নিশ্চয়, এবং যে-দুর্বলচিত্তগণ ইহাদের অনুকরণে ধাবিত হইবে, তাহারা সর্বপ্রকারে হাস্যজনক হইয়া উঠিবে, ইহাতেও সন্দেহ নাই । i যেটা লজ্জার বিষয়, সেইটো লইয়াই বিশেষরূপে গৌরব অনুভব করিতে বসিলে বন্ধুর কর্তব্য তাহাকে সচেতন করিয়া দেওয়া । যিনি সাহেবের অনুকরণ করিয়াছি মনে করিয়া গর্ববোধ করেন তিনি বস্তুত সাহেবের অনুকরণ করিতেছেন। সাহেবির অনুকরণ সহজ, কারণ তাহা বাহ্যিক জড় অংশ ; সাহেবের অনুকরণ শক্ত, কারণ তাহা আন্তরিক মনুষ্যত্ব। যদি সাহেবের অনুকরণ করিবার শক্তি র্তাহার থাকিত, তবে সাহেবির অনুকরণ কখনোই করিতেন না । অতএব কেহ যদি শিব গড়িতে গিয়া মাটির গুণে অন্য কিছু গড়িয়া বসেন, তবে সেটা লইয়া লম্বফঝম্বফ না করাই শ্ৰেয় । Swob প্ৰাচ্য ও প্ৰতাচ্য আমি যখন যুরোপে গেলুম তখন কেবল দেখলুম, জাহাজ চলছে, গাড়ি চলছে, লোক চলছে, দোকান চলছে, থিয়েটার চলছে, পার্লামেন্ট চলছে— সকলেই চলছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল বিষয়েই একটা বিপর্যয় চেষ্টা অহৰ্নিশি নিরতিশয় ব্যস্ত হয়ে রয়েছে ; মানুষের ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমা পাবার জন্যে সকলে মিলে অশ্রান্তভাবে ধাবিত হচ্ছে । দেখে আমার ভারতবষীয় প্রকৃতি ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে, এবং সেইসঙ্গে বিস্ময়-সহকারে বলে- ইয়া, এরাই রাজার জাত বটে । আমাদের পক্ষে যা যথেষ্টের চেয়ে ঢের বেশি এদের কাছে তা অকিঞ্চন দারিদ্র্য । এদের অতি সামান্য সুবিধাটুকুর জন্যেও, এদের অতি ক্ষণিক আমোদের উদ্দেশেও মানুষের শক্তি আপন পেশী ও স্নায়ু চরম সীমায় আকর্ষণ করে খেটে মরছে। জাহাজে বসে ভাবতুম এই যে জাহাজটি অহৰ্নিশি লীেহবক্ষ বিস্ফারিত করে চলেছে, ছাদের উপরে নরনারীগণ কেউ-বা বিশ্রামসুখে, কেউ-বা ক্ৰীড়াকৌতুকে নিযুক্ত ; কিন্তু এর গোপন জঠরের মধ্যে যেখানে অনন্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে, যেখানে অঙ্গরকৃষ্ণ নিরপরাধ নারকীরা প্রতিনিয়তই জীবনকে দগ্ধ করে সংক্ষিপ্ত করছে সেখানে কী অসহ্য চেষ্টা কী দুঃসাধ্য পরিশ্রম, মানবজীবনের কী নির্দয় অপব্যয় অশ্রান্তভাবে চলেছে । কিন্তু কী করা যাবে । আমাদের মানব-রাজা চলেছেন ; কোথাও তিনি থামতে চান না ; অনর্থক কাল নষ্ট কিংবা পথকষ্ট সহ্য করতে তিনি অসম্মত । র্তার জন্যে অবিশ্রাম যন্ত্রচালনা করে কেবলমাত্র দীর্ঘ পথকে হ্রাস করাই যথেষ্ট নয় ; তিনি প্রাসাদে যেমন আরামে, যেমন ঐশ্বর্যে থাকেন, পথেও তার তিলমাত্র ত্রুটি চান না । সেবার জন্যে শত শত ভূত্য অবিরত নিযুক্ত, ভোজনশালা, সংগীতমণ্ডপ সুসজ্জিত, স্বর্ণচিত্রিত শ্বেতপ্রস্তরমণ্ডিত শত বিদ্যুদীপে সমুজ্জ্বল। আহারকালে চৰ্য-চােষ্য-লোহা-পেয়ের সীমা নেই। জাহাজ পরিষ্কার রাখবার জন্যে কত নিয়ম কত বন্দোবস্ত ; জাহাজের প্রত্যেক দড়িটুকু যথাস্থানে সুশোভনভাবে গুছিয়ে রাখবার জন্য কত দৃষ্টি । যেমন জাহাজে, তেমনি পথে ঘাটে দোকানে নাট্যশালার গৃহে সর্বত্রই আয়োজনের আর অবধি নেই। দশদিকেই মহামহিম মানুষের প্রত্যেক ইন্দ্ৰিয়ের ষোড়শোপচারে পূজা হচ্ছে। তিনি মুহুর্তকালের জন্যে যাতে সন্তোষ লাভ করবেন তার জনো সংবৎসরকাল চেষ্টা চলছে। । এ-রকম চরমচেষ্টাচালিত সভ্যতাযন্ত্রকে আমাদের অন্তর্মনস্ক দেশীয় স্বভাবে যন্ত্রণ জ্ঞান করত । দেশে যদি একমাত্র যথেচ্ছাচারী বিলাসী রাজা থাকে। তবে তার শৌখিনতার আয়োজন করবার জন্যে অনেক অধমকে জীবনপাত করতে হয়, কিন্তু যখন শতসহস্র রাজা তখন মনুষ্যকে নিতান্ত দুর্বই