পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@8V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী চেতনা হবে। আপনার সঙ্গে পরের তুলনা করে নিজের যদি কোনো বিষয়ে অনভিজ্ঞ গ্ৰাম্যতা কিংবা অতিমাত্র বাড়াবাড়ি থাকে। তবে সেটা অদ্ভুত হাস্যকর অথবা দূষণীয় বলে ত্যাগ করতে পারব। আমাদের বহুকালের রুদ্ধ বাতায়নগুলো খুলে দিয়ে বাহিরের বাতাস এবং পূর্ব-পশ্চিমের দিবালোক ঘরের মধ্যে আনয়ন করতে পারব। যে-সকল নিজীবী সংস্কার আমাদের গৃহের বায়ু দূষিত করছে কিংবা গতিবিধির বাধারূপে পদে পদে স্থানবিরোধ করে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার বিদ্যুৎশিখা প্রবেশ করে কতকগুলিকে দগ্ধ এবং কতকগুলিকে পুনজীবিত করে দেবে। আমরা প্রধানত সৈনিক, বণিক অথবা পথিক -জাতি না হতেও পারি। কিন্তু আমরা সুশিক্ষিত পরিণতবুদ্ধি সহৃদয় উদারস্বভাব মানবহিতৈষী ধর্মপরায়ণ গৃহস্থ হয়ে উঠতে পারি এবং বিস্তর অর্থসামর্থ্য না থাকলেও সদাসচেষ্ট জ্ঞান প্রেমের দ্বারা সাধারণ মানবের যথেষ্ট সাহায্য করতেও পারি । অনেকের কাছে এ-আইডিয়ালটা আশানুরূপ উচ্চ না মনে হতেও পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা বেশ সংগত বোধ হয়। এমন-কি, আমার মনে হয় পালোয়ান হওয়া আইডিয়াল নয়, সুস্থ হওয়াই আইডিয়ােল। অভ্ৰভেদী মনুমেন্ট কিংবা পিরামিড আইডিয়াল নয়, বায়ু ও আলোকগম্য বাসযোগ্য সুদৃঢ় গৃহই আইডিয়ােল । , - একটা জ্যামিতির রেখা যতই দীর্ঘ এবং উন্নত করে তোলা যায় তাকে আকৃতির উচ্চ আদর্শ বলা যায় না । তেমনি মানবের বিচিত্র বৃত্তির সহিত সামঞ্জস্যরহিত একটা হঠাৎ গগনস্পশী বিশেষত্বকে মনুষ্যত্বের আইডিয়াল বলা যায় না। আমাদের অন্তর এবং বাহিরের সম্যক স্মৃর্তি সাধন করে আমাদের బ్లాగా সুস্থ সুন্দরভাবে সাধারণ প্রকৃত্তির অঙ্গীভূত করে দেওয়াই আমাদের যথার্থ সুপারণত । আমরা গৃহকোণে বসে রুদ্ৰ আৰ্যতেজে সমস্ত সংসারকে আপন মনে নিঃশেষে ভস্মসাৎ করে দিয়ে, মানবজাতির পনেরো আনা উনিশ গণ্ডা দুই পাইকে একঘরে করে কল্পনা করি পৃথিবীর মধ্যে আমরা আধ্যাত্মিক ; পৃথিবীতে আমাদের পদধূলি এবং চরণামৃত বিক্রয় করে চিরকাল আমরা অপরিমিত স্ফীতিভাব রক্ষা করতে পারব । অথচ সেটা আছে কি না আছে ঠিক জানি নে ; এবং যদি থাকে তো কোন সবল ভিত্তি অধিকার করে আছে তাও বলতে পারি। নে ; আমাদের সুশিক্ষিত উদার মহৎ হৃদয়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত আছে, না শাস্ত্রের শ্লোকরাশির মধ্যে নিহিত হয়ে আছে তাও বিবেচনা করে দেখি নে, সকলে মিলে চোখ বুজে নিশ্চিন্ত মনে স্থির করে রেখে দিই কোথাও-না-কোথাও আছে, নিজের অস্তরের মধ্যেই হােক, আর তুলটের পুঁথির মধ্যেই হােক, বর্তমানের মধ্যেই হােক আর অতীতের মধ্যেই হােক, অর্থাৎ আছেই হােক আর ছিলই হােক, ও একই কথা । ধনীর ছেলে যেমন মনে করে আমি ধনী অতএব আমার বিদ্বান হবার কোনো আবশ্যক নেই, এমন-কি, চাকরি।-পিপাসুদের মতো কলেজে পাস দেওয়া আমার বংশমর্যাদার হানিজনক তেমনি আমাদের শ্রেষ্ঠতাভিমানীরা মনে করেন। পৃথিবীর মধ্যে আমরা বিশেষ কারণে বিশেষ বড়ো, অতএব আমাদের আর-কিছু না করলেও চলে এমন-কি, কিছু না করাই কর্তব্য । äb এ দিকে হয়তো আমার পৈতৃক ধন সমস্ত উড়িয়ে বসে আছি। ব্যাঙ্কে আমার যা ছিল হয়তো তার কানাকড়ি অবশিষ্ট নেই কেবল এই কীটদষ্ট চেকবইটা মাত্র অবশিষ্ট আছে। যখন কেহ দরিদ্র অপবাদ দেয় তখন প্রাচীন লোহার সিন্দুক থেকে ঐ বইটা টেনে নিয়ে তাতে বড়ো বড়ো অঙ্কপাতপূর্বক খুব সতেজে নাম সই করতে থাকি । শত সহস্ৰ লক্ষ কোটি কলমে কিছুই বাধে না । কিন্তু যথার্থ তেজস্বী লোকে এ ছেলেখেলার চেয়ে মজুরি করে সামান্য উপার্জনও শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে । । অতএব আপাতত আমাদের কোনো বিশেষ মহত্ত্বে কাজ নেই। আমরা যে ইংরেজি শিক্ষা পাচ্ছি। সেই শিক্ষা দ্বারা আমাদের ভারতবষীয় প্রকৃতির অসম্পূর্ণতা দূর করে আমরা যদি পুরা প্রমাণসই একটা মানুষের মতো হতে পারি তা হলেই যথেষ্ট। তার পরে যদি সৈন্য হয়ে রাঙা কুর্তি পরে চতুদিকে লড়াই করে করে বেড়াই কিংবা আধ্যাত্মিক হয়ে ঠিক ভুর মধ্যবিন্দুতে কিংবা নাসিকার অগ্রভাগে অহৰ্নিশি৷ আপনাকে নিবিষ্ট করে রেখে দিই। সে পরের কথা । ।