পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

N GłGł শিক্ষা, চরিত্র ও আচরণ যেমনই হউক তঁাহারা আমাদের সাংসারিক মঙ্গলের প্রধান কারণ এবং তাহাদের প্রতি ভক্তিতে লাভ ও অভক্তিতে লোকসান আছে, এই বিশ্বাস আমাদের মাথাকে। তঁহাদের । পায়ের কাছে নত করিয়া রাখিয়াছে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বিশ্বাস এতদূর পর্যন্ত গিয়াছে যে, তাহারা গৃহধর্মনীিতির সুস্পষ্ট ব্যভিচার দ্বারাও গুরুভক্তিকে অন্যায় প্রশ্রয় দিয়া থাকেন। দেবতা সম্বন্ধেও সে কথা খাটে । দেবচরিত্র আমাদের আদর্শ চরিত্র হইবে, এমন আবশ্যক নাই । দেবভক্তিতে ফল আছে, কারণ দেবতা শক্তিমান । ব্ৰাহ্মণ সম্বন্ধেও তাহাই। ব্ৰাহ্মণ দুশ্চরিত্র নরাধম হইলেও ব্রাহ্মণ বলিয়াই পূজ্য। ব্ৰাহ্মণের কতকগুলি নিগৃঢ় শক্তি আছে। তঁহাদের প্রসাদে ও বিরাগে আমাদের ভালো মন্দ ঘটিয়া থাকে। এরূপ ভক্তিতে ভক্ত ও ভক্তিপাত্রের মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ থাকে না, দেনা-পাওনার সম্বন্ধই দাড়াইয়া যায়। সেই সম্বন্ধে ভক্তিপাত্রকেও উচ্চ হইতে হয় না এবং ভক্তও নীচতা লাভ করে । , কিন্তু আমাদের দেবভক্তি সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষিত অনেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম তর্ক করেন। র্তাহারা বলেন, ঈশ্বর যখন সর্বজ্ঞ সর্বব্যাপী তখন ঈশ্বর বলিয়া আমরা যাহাকেই পূজা করি, ঈশ্বরই সে-পূজা গ্ৰহণ করেন । অতএব এরূপ ভক্তি নিম্বফল নহে। পূজা যেন খাজনা দেওয়ার মতো ; স্বয়ং রাজার হস্তেই দিই। আর র্তাহার তহসিলদারের হস্তেই দিই, একই রাজভাণ্ডারে গিয়া জমা হয় । দেবতার সহিত দেনা-পাওনার সম্বন্ধ আমাদের মনে এমনই বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে, পূজার দ্বারা ঈশ্বরের যেন একটা বিশেষ উপকার করিলাম এবং তাহার পরিবর্তে একটা প্ৰত্যুপকার আমার পাওনা রহিল, ইহাই ভুলিতে না পারিয়া আমরা দেবভক্তি সম্বন্ধে এমন দোকানদারির কথা বলিয়া থাকি । পূজাটা দেবতার হস্তগত হওয়াই যখন বিষয়, এবং সেটা ঠিকমত র্তাহার ঠিকানায় পৌঁছিলেই যখন আমার কিঞ্চিৎ লাভ আছে, তখন যত অল্প ব্যয়ে অল্প চেষ্টায় সেটা চালান করা যায় ধর্ম-ব্যবসায়ে ততই আমার জিত। দরকার কী ঈশ্বরের স্বরূপ ধারণার চেষ্টায়, দরকার কী কঠোর সত্যানুসন্ধানে ; সম্মুখে কাষ্ঠ প্রস্তর যাহা উপস্থিত থাকে তাহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা নিবেদন করিয়া দিলে যাহার পূজা তিনি আপনি ব্যগ্ৰ হইয়া আসিয়া হাত বাড়াইয়া লইবেন। আমাদের পুরাণে ও প্রচলিত কাব্যে যেরূপ বর্ণনা আছে, তাহাতে মনে হয় যেন দেবতারা আপনাদের পূজা গ্রহণের জন্য মৃতদেহের উপর শকুনি-গৃধিনীর ন্যায় কড়াকড়ি ছেড়াছড়ি করিতেছেন। অতএব আমাদের নিকট হইতে ভক্তিগ্রহণের লোলুপতা যে ঈশ্বরেরই, এ কথা আমাদের কিন্তু কী মনুষ্যপূজায় এবং কী দেবপূজায়, ভক্তি ভক্তেরই লাভ। র্যাহাকে ভক্তি করি তিনি না জানিলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু তাহাকেই আমার জানা চাই, তবেই আমার ভক্তির সার্থকতা। পূজ্য ব্যক্তির আদর্শকে আমাদের প্রকৃতির সহিত সম্পূর্ণ মিশাইয়া লইতে চাহিলে ভক্তি ছাড়া আর কোনো উপায়ই নাই। আমরা র্যাহাকে পূজা করি তাহাকেই যদি বস্তুত চাই। তবে তাহার প্রকৃতির আদর্শর্তাহার সত্যস্বরূপ একান্ত ভক্তিযোগে হৃদয়ে স্থাপনা করিতে হয়। সেরূপ অবস্থায় ফাকি দিতে স্বতই প্রবৃত্তি হয় না ; তাহার সহিত বৈসাদৃশ্য ও দূরত্ব যতই দীনত্বের সহিত অনুভব করি, ততই ভক্তি বাড়িয়া উঠিয়া ক্ষুদ্র আপনাকে তাহার সহিত লীন করিবার চেষ্টা করে। ইহাই ভক্তির গৌরব। ভক্তিরস সেই আধ্যাত্মিক রসায়নশক্তি যাহা ক্ষুদ্রকে বিগলিত করিয়া । মহাতের সহিত মিশ্ৰিত করিতে পারে। অতএব ঈশ্বরকে যখন ভক্তি করি তখন তন্দ্বারা তাহার ঐশ্বৰ্য বাড়ে না, আমরাই সেই রসস্বরূপের মাসায়নিক মিলন লাভ করি । আমাদের ঈশ্বরের আদর্শ যত মহৎ মিলনের আনন্দ ততই প্ৰগাঢ়, এবং তদ্বারা আত্মার প্রসার ততই বিপুল হইবে। ভক্তি আমরা যাহাকে করি, তাহাকে ছাড়া আর কাহাকেও পাই না। যদি গুরুকে ব্ৰহ্ম বলিয়া ভক্তি করি, তবে সে গুরুর আদর্শই আমাদের মনে অঙ্কিত হয়। ভক্তির প্রবলতায় সেই গুরুর মানস আদর্শ