পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিক্ষা ৫৬৭ ইংরেজি ভাষা ভাব আচার ব্যবহার এবং সাহিত্য তাঁহাদের নিকট কখনোই সুপরিচিত নহে। তাহারাই ইংরেজির সহিত আমাদের প্রথম পরিচয় সংঘটন করাইয়া থাকে। তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি ; কেবল তাঁহাদের একটা সুবিধা এই যে, শিশুদিগকে শিখানাে অপেক্ষা ভুলানো ঢ়োর সহজ কাজ, এবং তাঁহাতে তাহারা সম্পূর্ণ কৃতকার্যতা লাভ করে । BBBB SBBB EOD D B S LLLLL LLL LLLL LLLLLLLLS S BB LBD DBBDB BBD বাংলারও ঠিক থাকে না, ইংরেজিও ঘোলাইয়া যায়। কথাটা কেমন করিয়া প্রকাশ করা যায় । ঘোড়া । একটি মহৎ জন্তু, ঘোড়া অতি উচুদরের জানােয়ার, ঘোড়া জন্তুটা খুব ভালো— কথাটা কিছুতেই তেমন মনঃপূতরকম হয় না, এমন স্থলে গোজামিলন দেওয়াই সুবিধা । আমাদের প্রথম ইংরেজি শিক্ষায় এইরূপ কত গোজামিলন চলে তাহার আর সীমা নাই। ফলত অল্পবয়সে আমরা যে ইংরেজিটুকু শিখি তাহা এত যৎসামান্য এবং এত ভুল যে, তাহার ভিতর হইতে কোনোপ্রকারের রস আকর্ষণ করিয়া লওয়া বালকদের পক্ষে অসম্ভব হয়— কেহ তাহা প্রত্যাশাও করে না। মাস্টারও বলে ছাত্রও বলে, আমার রসে কাজ নাই, টানিয়া-বুনিয়া কোনোমতে একটা অর্থ বাহির করিতে পারিলে এ যাত্রা বাচিয়া যাই, পরীক্ষায় পাস হই ; আপিসে চাকরি জোটে । সচরাচর যে-অর্থটা বাহির হয় তৎসম্বন্ধে শঙ্করাচার্যের এই বচনটি খাটে ; অর্থমনৰ্থং ভাবয় নিত্যং নাস্তি ততঃ সুখলেশঃ সত্যম। " অর্থকে অনৰ্থ বলিয়া জানিয়ো, তাহাতে সুখও নাই এবং সত্যও নাই। তবে ছেলেদের ভাগ্যে বাকি রহিল কী । যদি কেবল বাংলা শিখিত তবে রামায়ণ মহাভারত পড়িতে পাইত ; যদি কিছুই না শিখিত। তবে খেলা করিবার অবসর থাকিত, গাছে চড়িয়া, জলে ঝাপাইয়া, ফুল ছিড়িয়া প্রকৃতিজননীর উপর সহস্ৰ দৌরাত্ম্য করিয়া শরীরের পুষ্টি, মনের উল্লাস এবং বাল্যপ্রকৃতির - পরিতৃপ্তি লাভ করিতে পারিত। আর ইংরেজি শিখিতে গিয়া না হইল শেখা না হইল খেলা, প্রকৃতির সত্যরাজ্যে প্ৰবেশ করিবারও অবকাশ থাকিল না, সাহিত্যের কল্পনারাজ্যে প্ৰবেশ করিবারও দ্বার রুদ্ধ রহিল। অন্তরে এবং বাহিরে যে-দুইটি উদার এবং উন্মুক্ত বিহারক্ষেত্র আছে, মনুষ্য যেখান হইতে জীবন বল এবং স্বাস্থ্য সঞ্চয় করে, যেখানে নানা বর্ণনানা রূপ নানা গন্ধ, বিচিত্র গতি এবং গীতি, শ্ৰীতি ও প্রফুল্লতা সর্বদা হিল্লোলিত হইয়া আমাদিগকে সর্বাঙ্গসচেতন এবং সম্পূর্ণ বিকশিত করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে সেই দুই মাতৃভূমি হইতে নির্বাসিত করিয়া হতভাগ্য শিশুদিগকে কোন বিদেশী কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখা হয়। ঈশ্বর যাহাদের জন্য পিতামাতার হৃদয়ে স্নেহ সঞ্চার অধিকার করিয়াও তাঁহাদের খেলার জন্য যথেষ্ট স্থান পায় না। তাহাদিগকে কোথায় বাল্য যাপন করিতে হয় ; বিদেশী ভাষার ব্যাকরণ এবং অভিধানের মধ্যে। যাহার মধ্যে জীবন নাই, আনন্দ নাই, অবকাশ । নাই, নবীনতা নাই, নড়িয়া বসিবার এক তিল স্থান নাই, তাহারই অতি শুষ্ক কঠিন সংকীর্ণতার মধ্যে। ইহাতে কি সে-ছেলের কখনো মানসিক পুষ্টি, চিত্তের প্রসার, চরিত্রের বলিষ্ঠতা লাভ হইতে পারে। সে কি একপ্রকার পাণ্ডুবৰ্ণ রক্তহীন শীর্ণ অসম্পূর্ণ হইয়া থাকে না । সে কি বয়ঃপ্রাপ্তিকালে নিজের বুদ্ধি খটটাইয়া কিছু বাহির করিতে পারে, নিজের বল খাটাইয়া বাধা অতিক্রম করিতে পারে, নিজের স্বাভাবিক তেজে মস্তক উন্নত করিয়া রাখিতে পারে। সে কি কেবল মুখস্থ করিতে, নকল করিতে এবং গোলামি করিতে শেখে না ।

  • বয়স হইতে আর-এক বয়স পর্যন্ত একটা যোগ আছে। যৌবন যে বাল্যকাল হইতে ক্রমশ পরিণত হইয়া উঠে। এ কথা নূতন করিয়া বলাই বাহুল্য। যৌবনে সহসা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াই যখন যাহা আবশ্যক অমনি যে হাতের কাছে পাওয়া যায় তাহা নহে— জীবনের যথার্থ নির্ভরযোগ্য এবং একান্ত আবশ্যক জিনিস হস্তপদের মতো আমাদের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়া উঠিতে থাকে।