পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ ዓ S রবীন্দ্র-রচনাবলী হইতে সম্পূর্ণ গোপন করিব না, আমার ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক প্রবন্ধের ফুটনােটে নানা ভাষার দুরূহ গ্ৰন্থ হইতে নানা বচন ও দৃষ্টান্ত সংগ্ৰহ করিয়া দেখাইতে পারিব, এবং বিলাতি সাহিত্যের কোন পুস্তক সম্বন্ধে কোন সমালোচক কী কথা বলেন তাহাও বাঙালির অগোচর থাকিবে না। কিন্তু যদি তোমাদের এই জীৰ্ণচীর অসম্পূর্ণ ভাষা আদেশমাত্র অগ্রসর হইয়া আমাকে সমােদর করিয়া না লয়। তবে আমি বাংলায় লিখিব না, আমি ওকালতি করিব, ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হইব, ইংরেজি খবরের কাগজে লীডার লিখিব, তোমাদের যে কত ক্ষতি হইবে তাহার। আর ইয়াত্তা নাই । বঙ্গদেশের পরম দুৰ্ভাগ্যক্রমে তাহার এই লজ্জাশীল অথচ তেজস্বিনী নন্দিনী বঙ্গভাষা অগ্রবর্তিনী হইয়া এমন-সকল ভালো ভালো ছেলের সমাদর করে না এবং ভালো ছেলেরাও রাগ করিয় বাংলাভাষার সহিত কোনো সম্পর্ক রাখে না। এমন-কি, বাংলায় চিঠিও লেখে না, বন্ধুদের সহিত সাক্ষাৎ হইলে যতটা পারে বাংলা হাতে রাখিয়া ব্যবহার করে এবং বাংলাগ্রন্থ অবজ্ঞােভরে অন্তঃপুরে নির্বাসিত করিয়া দেয় । ইহাকে বলে লঘু পাপে গুরু দণ্ড । পূর্বে বলিয়াছি, আমাদের বাল্যকালের শিক্ষায় আমরা ভাষার সহিত ভাব পাই না, আবার বয়স হইলে ঠিক তাহার বিপরীত ঘটে, যখন ভাব জুটিতে থাকে তখন ভাষা পাওয়া যায় না। এ কথাও পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি যে, ভাষাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভাবশিক্ষা একত্র অবিচ্ছেদ্যভাবে বৃদ্ধি পায় না বলিয়াই যুরোপীয় ভাবের যথার্থ নিকট সংসৰ্গ আমরা লাভ করি না এবং সেইজন্যই আজকাল আমাদের অনেক শিক্ষিত লোকে যুরোপীয় ভাবসকলের প্রতি অনাদর প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন । অন্যদিকেও তেমনই ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই আপনার মাতৃভাষাকে দৃঢ়-সম্বন্ধ রূপে পান নাই বলিয়া মাতৃভাষা হইতে তাহারা দূরে পড়িয়া গেছেন এবং মাতৃভাষার প্রতি র্তাহাদের একটি অবজ্ঞা জন্মিয়া গেছে। বাংলা তাহারা জানেন না। সে কথা স্পষ্টরূপে স্বীকার না করিয়া তাহারা বলেন, “বাংলায় কি কোনো ভাব প্ৰকাশ করা যায় । এ ভাষা আমাদের মতো শিক্ষিত মনের উপযোগী নহে।” প্রকৃত কথা, আঙুর যে দিক হইতে যেমন করিয়াই দেখা যায়, আমাদের ভাব ভাষা এবং জীবনের মধ্যকার সামঞ্জস্য দূর হইয়া গেছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হইয়া নিম্বফল হইতেছে, আপনার মধ্যে একটি অখণ্ড ঐক্যলাভ করিয়া বলিষ্ঠ হইয়া দাড়াইতে পারিতেছে না, যখন যেটি আবশ্যক। তখন সেটি হাতের কাছে পাইতেছে না। একটি গল্প আছে, একজন দরিদ্র সমস্ত শীতকালে অল্প অল্প ভিক্ষা সঞ্চয় করিয়া যখন শীতবস্ত্ৰ কিনিতে সক্ষম হইত। তখন গ্ৰীষ্ম আসিয়া পড়িত, আবার সমস্ত গ্ৰীষ্মকাল চেষ্টা করিয়া যখন লঘুবস্ত্ৰ লাভ করিত তখন অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি ; দেবতা যখন তাহার দৈন্য দেখিয়া দয়াৰ্দ্ধ হইয়া বর দিতে চাহিলেন তখন সে কহিল, “আমি আর কিছু চাহি না, আমার এই হেরফের ঘুচাইয়া দাও । আমি যে সমস্ত জীবন ধরিয়া গ্ৰীষ্মের সময় শীতবস্ত্র এবং শীতের সময় গ্ৰীষ্মবন্ত্র লাভ করি। এইটে যদি একটু সংশোধন করিয়া দাও তাহা হইলেই আমার জীবন সার্থক হয়।” । আমাদেরও সেই প্রার্থনা । আমাদের হেরফের ঘুচিলেই আমরা চরিতার্থ হই। শীতের সহিত শীতবস্ত্র, গ্ৰীষ্মের সহিত গ্ৰীষ্মবন্ত্র কেবল একত্র করিতে পারিতেছি না বলিয়াই আমাদের এত দৈন্য, নহিলে আছে সকলই ; এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাহি, আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্ৰ, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও । আমরা আছি GRAN : পানীমে মীন পিয়াসি শুনত শুনত লাগে হাসি । আমাদের পানীও আছে পিয়াসও আছে, দেখিয়া পৃথিবীর লোক হাসিতেছে, এবং আমাদের চক্ষে অশ্রু আসিতেছে, কেবল আমরা পান করিতে পারিতেছি না । r > ૨છે છે