পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিক্ষা Ꮚ ᏄᏬ শিক্ষা-সংস্কার যাহারা খবরের কাগজ পড়েন তাহারা জানেন, ইংলন্ডে ফ্রান্সে শিক্ষা সম্বন্ধে খুব একটা গোলমাল চলিতেছে। শিক্ষা লইয়া আমরাও নিশ্চিন্ত নাই, তাহাও কাহারও অবিদিত নাই । r এমন সময়ে ‘স্পীকার’ নামক বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক-পত্রে আইরিশ শিক্ষাসংস্কার সম্বন্ধে যে প্ৰস্তাব আলোচিত হইয়াছে, তাহা আমাদের মনোযোগপূর্বক চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয় । যুরোপের যে-যুগকে অন্ধকার যুগ বলে, যখন বর্বর আক্রমণের ঝড়ে রোমের বাতি নিবিয়া গেল, সেই সময়ে যুরোপের সকল দেশের মধ্যে কেবলমাত্র আয়রলন্ডেই বিদ্যার চর্চা জাগিয়াছিল । তখন যুরোপের ছাত্ৰগণ আয়রলন্ডের বিদ্যালয়ে আসিয়া পড়াশুনা করিত। সপ্তম শতাব্দীতে যখন বহুতর বিদার্থী এখানে আসিয়া জুটিয়াছিল, তখন তাহারা আহার বাসা পুঁথি এবং শিক্ষা বিনামূল্যেই পাইত । কতকটা আমাদের দেশের টোলের মত আর কি । যুরোপের অধিকাংশ দেশেই আইরিশ বৈরাগিগণ বিদ্যা এবং খৃস্টধর্মের নির্বাণপ্ৰায় শিখা আবার বিখ্যাত আইরিশ পণ্ডিত ক্লেমেন্সের হাতে দিয়াছিলেন। এরূপ আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে। । প্রাচীন আইরিশ বিদ্যালয়ে যদিচ লাটিন, গ্ৰীক এবং হিব্রু শেখানো হইত, তবু সেখানে শিখাইবার ভাষা ছিল আইরিশ । গণিতজ্যোতিষ, ফলিত জ্যোতিষ এবং তখনকার কালে যে-সকল বিজ্ঞান প্ৰচলিত ছিল তাহা আইরিশ ভাষাদ্বারাই শেখানাে হইত, সুতরাং এ ভাষার পরিভাষিক শব্দের দৈন্য ছিল না। যখন দিনেমার এবং ইংরেজরা আয়রলান্ড আক্রমণ করে, তখন এই সকল বিদ্যালয়ে আগুন লাগাইয়া বিপুলসঞ্চিত পুঁথিপত্র জ্বালাইয়া দেওয়া হয় এবং অধ্যাপক ও ছাত্ৰগণ হত ও বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে। কিন্তু আয়রলন্ডের যে যে স্থান এই সকল উৎপাত হইতে দূরে থাকিয়া ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দেশীয় রাজাদের অধীন ছিল, সে-সকল স্থানের বড়ো বড়ো বিদ্যাসারে শিক্ষাকার্য সম্পূর্ণ আইরিশ । প্ৰণালীতেই নির্বাহিত হইত। অবশেষে এলিজাবেথের কালে লড়াই হইয়া যখন সমস্ত সম্পত্তি অপহৃত । হইল, তখন আয়রলন্ডের স্বায়ত্তবিদ্যা ও বিদ্যালয় একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়া হইল । এইরূপে আয়রলান্ডবাসীরা জ্ঞানচর্চা হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিল, তাহাদের ভাষা নিকৃষ্টসমাজের ভাষা বলিয়া অবজ্ঞা প্ৰাপ্ত হইতে থাকিল। অবশেষে উনবিংশ শতাব্দীতে “ন্যাশনাল ইস্কুল প্ৰণালীর সূত্রপাত হইল। জ্ঞানপিপাসু আইরিশগণ এই প্ৰণালীর দোষগুলি বিচারমাত্র না করিয়া ব্যগ্ৰভাবে ইহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইল"। কেবল একজন বড়োলোক-টুয়ামের আর্চবিশপ জন ম্যাকহেল— এই প্ৰণালীর বিরুদ্ধে আপত্তি প্ৰকাশ করেন এবং ইহার দ্বারা ভবিষ্যতে যে অমঙ্গল হইবে তাহা ব্যক্তি আইরিশদিগকে জোর করিয়া স্যাকসনের ছাচে ঢালা এবং ইংরেজ করিয়া তোলাই ইস্কুল-প্ৰণালীর মতলব ছিল । ফলে এই চেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হইল। ভালোই বলো আর মন্দই বলো, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে এমন ভিন্ন রকম করিয়া গড়িয়াছেন যে, এক জাতকে ভিন্ন জাতের কাঠামোর মধ্যে পুরিতে গেলে সমস্ত খাপছাড়া হইয়া যায়। যে-সময়ে এই শিক্ষাপ্রণালীর প্রবর্তন করা হয়, তখন আয়রলন্ডের শতকরা আশিজন লোক আইরিশ ভাষায় কথা কহিত । যদি শিক্ষা দেওয়াই ন্যাশনাল বোর্ডের উদ্দেশ্য হইত, তবে আইরিশ ইত্ৰদিগকে আগে নিজের ভাষায় পড়িতে শুনিতে শিখাইয়া তাহার পরে সেই মাতৃভাষার সাহায্যে তাহাদিগকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহা না করিয়া নানাপ্রকার কঠিন শাস্তিদ্বারা বালকদিগকে তাহাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করিতে একেবারে নিরস্ত করিয়া দেওয়া হইল। শুধু ভাষা নয়, আইরিশ ইতিহাস পড়ানো বন্ধ হইল ; আইরিশ ভুবৃত্তান্তও ভালো করিয়া শেখানো ইহঁত না । ছেলেরা বিদেশের ইতিহাস ও ভুবৃত্তান্ত শিখিয়া নিজের দেশের সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিত । ইহার ফল। যেমন হওয়া উচিত, তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল ।