পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(Str রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া তোলে। দৃষ্টান্তস্বরূপে বলিতে পারি, প্যাট্রিয়টিজম-নামক পদার্থ। ইহার মধ্যে যেটুকু সতা ছিল, প্রতিদিন সকলে পড়িয়া সেটাকে তুলা ধূনিয়া একটা প্ৰকাণ্ড মিথ্যা করিয়া তুলিয়াছে ; এখন এই তৈরি বুলিটাকে প্রাণপণ চেষ্টায় সত্য করিয়া তুলিবার জন্য কত কৃত্রিম উপায়, কত অলীক উদ্দীপনা, কত অন্যায় শিক্ষা, কত গড়িয়া-তোলা বিদ্বেষ, কত কূট যুক্তি, কত ধর্মের ভান সৃষ্ট হইতেছে তাহার সীমা সংখ্যা নাই। এই সকল স্বভাবভ্রষ্ট কুহেলিকার মধ্যে মানুষ বিভ্রান্ত হয়— সরল ও উদার, প্রশান্ত ও সুন্দর হইতে সে কেবল দূরে চলিয়া যাইতে থাকে । কিন্তু বুলির মোহ ভাঙানো বড়ো শক্ত । বস্তুকে আক্রমণ করিয়া ভূমিসাৎ করা যায়, বুলির গায়ে ছুরি বসে না। এইজন্য বুলি লইয়া মানুষে মানুষে যত ঝগড়া, যত রক্তপাত হইয়াছে, এমন তো বিষয় লইয়া হয় নাই। — সমাজে সরল অবস্থায় দেখিতে পাই, লোকে যেটুকু জানে তাহা মানে । সেটুকুর প্রতি তাহাদের নিষ্ঠা আটল ; তাহার জন্য ত্যাগাস্বীকার, কষ্টস্বীকার তাহাদের পক্ষে সহজ । ইহার কতকগুলি কারণ আছে ; কিন্তু একটি প্রধান কারণ, তাহাদের হৃদয় মন মতের দ্বারা আবৃত হইয়া যায় নাই ; যতটুকু সত্য বলিয়া গ্ৰহণ করিবার অধিকার ও শক্তি তাহাদের আছে ততটুকুই তাহারা গ্ৰহণ করিয়াছে। মন যাহা সত্যরূপে গ্ৰহণ করে, হৃদয় তাহার জন্য অনেক ক্লেশ অনায়াসেই সহিতে পারে ; সেটাকে সে বাহাদুরি বলিয়া মনেই করে না । সভ্যতার জটিল অবস্থায় দেখা যায়, মতের বহুতর স্তর জমিয়া গেছে। কোনোটা চার্চের মত, চর্চার মত নহে ; কোনোটা সভার মত, ঘরের মত নহে ; কোনোটা দলের মত, অন্তরের মত নহে ; কোনো মতে চোখ দিয়া জল বাহির হয়, পকেট হইতে টাকা বাহির হয় না ; কোনো মতে টাকাও বাহির হয়, কাজও চলে- কিন্তু হৃদয়ে তাহার স্থান নাই, ফ্যাশানে তাহার প্রতিষ্ঠা । এই সকল অবিশ্রাম-উৎপন্ন ভুরি ভুরি সত্যবিকারের মাঝখানে পড়িয়া মানুষের মন সত্য-মতকেও অবিচলিত সত্যরূপে গ্ৰহণ করিতে পারে না । এইজন্য তাহার আচরণ সর্বত্র সর্বতোভাবে সত্য হইতে পারে না । সে সরলভাবে আপন শক্তি ও প্রকৃতি অনুযায়ী কোনো পন্থা নির্বাচন করিবার অবকাশ না পাইয়া বিভ্রান্তভাবে দশের কথার পুনরাবৃত্তি করিতে থাকে, অবশেষে কাজের বেলায় তাহার প্রকৃতির মধ্যে বিরোধ বাধিয়া যায়। সে যদি নিজের স্বভাবকে নিজে পাইত, তবে সেই স্বভাবের ভিতর দিয়া যাহা-কিছু পাইত, তাহা ছােটাে হউক বড়ো হউক খাটি জিনিস হইত। তাহা তাহাকে সম্পূর্ণ বল দিত, সম্পূর্ণ আশ্রয় দিত ; সে তাহাকে সর্বতোভাবে কাজে না খাটাইয়া থাকিতে পারিত না । এখন তাহাকে গোলেমালে পড়িয়া পুঁথির মত, মুখের মত, সভার মত, দলের মত লইয়া ধুবলক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া কেবল বিস্তর কথা আওড়াইয়া বেড়াইতে হয় । সেই কথা আওড়াইয়া বেড়ানোকে সে হিতকর্ম বলিয়া মনে করে ; সেজন্য সে বেতন পায় ; তাহা বেচিয়া সে লাভ করে ; এই সকল কথার একটুখানি এদিক-ওদিক লইয়া সে অন্য সম্প্রদায়, অন্য জাতিকে হেয় এবং নিজের জাতি ও দলকে শ্রদ্ধেয় বলিয়া প্রচার করে । মানুষের মনের চারি দিকে এই-যে অতিনিবিড় পুঁথির অরণ্যে বুলির বোল ধরিয়াছে, ইহার মোদোেগন্ধে আমাদিগকে মাতাল করিতেছে, শাখা হইতে শাখাস্তরে কেবলই চঞ্চল করিয়া মারিতেছে ; কিন্তু যথার্থ আনন্দ, গভীর তৃপ্তি দিতেছে না । নানাপ্রকার বিদ্রোহ ও মনোবিকার উৎপন্ন করিতেছে । সহজ জিনিসের গুণ এই যে, তাহার স্বাদ কখনােই পুরাতন হয় না, তাহার সরলতা তাহাকে চিরদিন নবীন করিয়া রাখে। যাহা যথার্থ স্বভাবের কথা, তাহা মানুষ যতবার বলিয়াছে ততবারই নূতন লাগিয়াছে। পৃথিবীতে গুটি-দুই-তিন মহাকাব্য আছে যাহা সহস্রবৎসরেও স্নান হয় নাই ; নির্মল জলে মতো তাহা আমাদের পিপাসা হরণ করিয়া তৃপ্তি দেয়, মদের মতো তাহা আমাদিগকে উত্তেজনার ডগার উপরে তুলিয়া শুষ্ক অবসাদের মধ্যে আছাড় মারিয়া ফেলে না। সহজ হইতে দূরে আসিলেই একবার উত্তেজনা ও একবার অবসাদের মধ্যে কেবলই টেকি-কোটা হইতে হয় । উপকরণবহুল অতিসভ্যতার ইহাই ব্যাধি । - -এই জঙ্গলের ভিতর দিয়া পথ বাহির করিয়া, এই রাশীকৃত পুঁথি ও বচনের আবরণ ভেদ করিয়া, সমাজের মধ্যে, মানুষের মনের মধ্যে স্বভাবের বাতাস ও আলোক আনিবার জন্য মহাপুরুষ এবং