পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পূর্বে আমার বিশ্বাস ছিল আমাদের বাংলা-অক্ষর উচ্চারণে কোনো গোলযোগ নাই। কেবল তিনটি স, দুটাে ন ও দুটাে জ শিশুদিগকে বিপাকে ফেলিয়া থাকে। এই তিনটে স-এর হাত এড়াইবার জন্যই পরীক্ষার পূর্বে পণ্ডিতমশায় ছাত্ৰাদিগকে পরামর্শ দিয়াছিলেন যে, “দেখো বাপু, ‘সুশীতল সমীরণ লিখতে যদি ভাবনা উপস্থিত হয় তো লিখে দিয়ো ঠাণ্ডা হাওয়া” ” এ ছাড়া দুটাে ব-এর মধ্যে একটা বা কোনো কাজে লাগে না । ঋ৯ঙঞ-গুলো কেবল সঙ সাজিয়া আছে। চেহারা দেখিলে হাসি আসে, কিন্তু মুখস্থ করিবার সময় শিশুদের বিপরীত ভাবোদয় হয়। সকলের চেয়ে কষ্ট দেয় দীর্ঘ হ্রস্ব স্বর। কিন্তু বর্ণমালার মধ্যে যতই গোলযোগ থাকি-না কেন, আমাদের উচ্চারণের মধ্যে কোনো অনিয়ম নাই, এইরূপ আমার ধারণা ছিল । ইংলন্ডে থাকিতে আমার একজন ইংরেজ বন্ধুকে বাংলা পড়াইবার সময় আমার চৈতন্য হইল, এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ সমূলক নয়। এ বিষয়ে আলোচনা করিবার পূর্বে একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক । বাংলা দেশের নানাস্থানে নানাপ্রকার উচ্চারণের ভঙ্গি আছে । কলিকাতা অঞ্চলের উচ্চারণকেই আদর্শ ধরিয়া লইতে হইবে । কারণ, কলিকাতা রাজধানী। কলিকাতা সমস্ত বঙ্গভূমির সংক্ষিপ্তসার । হরি শব্দে আমরা হ যেরূপ উচ্চারণ করি, হর শব্দে হী সেরূপ উচ্চারণ করি না । দেখা শব্দের একার একরূপ এবং দেখি শব্দের একার আর-একরূপ । পবন শব্দে পা অকারান্ত, বা ওকারান্ত, ন হসন্ত শব্দ । শ্বাস শব্দের শ্ব-র উচ্চারণ বিশুদ্ধ শ-এর মতো, কিন্তু বিশ্বাস শব্দের শ্ব-এর উচ্চারণ শশ-এর ন্যায়। “ব্যয় লিখি কিন্তু পড়ি- ব্যায় । অথচ অব্যয় শব্দে ব্য-এর উচ্চারণ কবি-এর মতো । আমরা লিখি গর্দভ, পড়ি— গর্ধেব । লিখি “স, পড়ি- সোজাঝে । এমন কত লিখিব । আমরা বলি আমাদের তিনটে স-এর উচ্চারণে কোনো তফাত নাই, বাংলায় সকল স-ই তালব্য শ-এর ন্যায় উচ্চারিত হয় ; কিন্তু আমাদের যুক্ত-অক্ষর উচ্চারণে এ কথা খাটে না । তার সাক্ষ্য দেখো কষ্ট শব্দ এবং ব্যস্ত শব্দের দুই শ-এর উচ্চারণের প্রভেদ আছে। প্রথমটি তালব্য শ, দ্বিতীয়টি দন্ত্য স | “আসতে হবে এবং “আশ্চর্য এই উভয় পদে দন্ত্য স ও তালব্য শ-এর প্রভেদ রাখা হইয়াছে । জ-এর উচ্চারণ কোথাও বা ইংরেজি z-এর মতো হয়, যেমন লুচি ভাজতে হবে, এ স্থলে ভাজতে শব্দের জ ইংরেজি z-এর মতো । । সচরাচর আমাদের ভাষায় অস্ত্যস্থ ব-এর আবশ্যক হয় না বটে, কিন্তু জিহবা অথবা আহবান শব্দে অস্ত্যস্থ ব ব্যবহৃত হয় । । আমরা লিখি “র্তাহারা” কিন্তু উচ্চারণ করি।-- তাহীরা অথবা তাহীরা। এমন আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে । বাংলা ভাষায় এইরূপ উচ্চারণের বিশৃঙ্খলা যখন নজরে পড়িল, তখন আমার জানিতে কৌতুহল হইল, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা নিয়ম আছে কি না। আমার কাছে তখন খান-দুই বাংলা অভিধান ছিল । মনোযোগ দিয়া তাহা হইতে উদাহরণ সংগ্ৰহ করিতে লাগিলাম। যখন আমার খাতায় অনেকগুলি উদাহরণ সঞ্চিত হইল, তখন তাহা হইতে একটা নিয়ম বাহির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এই সকল উদাহরণ এবং তাহার টীিকায় রাশি রাশি কাগজ পুরিয়া গিয়াছিল। যখন দেশে আসিলাম তখন এই কাগজগুলি আমার সঙ্গে ছিল । একটি চামড়ার বাক্সে সেগুলি রাখিয়া আমি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত ছিলাম। দুই বৎসর হইল, একদিন সকালবেলায় ধূলা ঝাড়িয়া বাক্সটি খুলিলাম, ভিতরে