পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 by রবীন্দ্র-রচনাবলী পদদ্বৈতমূলক যেমন, বলাবলি দলাদলি ইত্যাদি। 4 ধ্বনিমূলক শব্দগুলি দুই রকমের ; একটা ধ্বনিদ্বৈত, আর-একটা ধ্বনিদ্বৈধ। ধ্বনিদ্বৈত যেমন, কলকল কটকট ইত্যাদি ; ধ্বনিদ্বৈধ যেমন, ফুটফাট কুপকাপ ইত্যাদি । ধ্বনিমূলক এই শব্দগুলি আমাদের ইন্দ্ৰিয়বোধ বেদনাবোধ প্রভৃতি অনুভূতি প্ৰকাশ করে। 甲 পদবিকারমূলক শব্দগুলি একটা নির্দিষ্ট অর্থকে কেন্দ্ৰ করিয়া তাহার চারিদিকে অনির্দিষ্ট আভাসটুকু ফিকা করিয়া লেপিয়া দেয়। পদদ্বৈতমূলক শব্দগুলি সাধারণত অন্যোন্যতা প্রকাশ করে। ধ্বনিদ্বৈধ ও পদবিকারমূলক শব্দগুলিতে আমরা এ পর্যন্ত কেবল স্বরবিকারেরই পরিচয় পাইয়াছি ; যেমন, হুসহাস- হুসের সহিত যে বৰ্ণভেদ ঘটিয়াছে তাহা স্বরবর্ণভেদ ; খোলাখালা প্রভৃতি শব্দ সম্বন্ধেও সেইরূপ । এবারে ব্যঞ্জনবর্ণ-বিকারের দৃষ্টান্ত লইয়া পড়িব । প্রথমে অর্থহীন শব্দমূলক কথাগুলি দেখা যাক ; যেমন, উসখুসি উস্কো খুস্কো নজগজ নিশপিশ আইঢাই কঁচুমাচু আবাল-তাবল হাসফাস খুঁটিনাটি আগড়ম-বাগড়ম এবড়ো-খেবড়ো ছটফট তড়বড় হিজিবিজি ফষ্টিনষ্টি আঁকুৰ্বাকু হাবজা-গোবজা লটখাটে তড়বড়ে ইত্যাদি । এই কথাগুলির অধিকাংশই আগাগোড়া অনির্দিষ্টভাব প্রকাশ করে । হাতপা চোখমুখ কাপড়চোপড় লইয়া ছোটােখাটাে কত কী করাকে যে উসখুসি করা বলে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে গেলে হতাশ হইতে হয় ; কী কী বিশেষ কাৰ্য্য করাকে যে আইঢাই করা বলে তাহা আমাদের মধ্যে কে ব্যাখ্যা করিয়া বলিতে পারেন । কঁচুমাচু করা কাহাকে বলে তাহা আমরা বেশ জানি, কিন্তু কঁচুমাচু করার প্রক্রিয়াটি যে কী তাহা সুস্পষ্ট ভাষায় বলিবার ভার লইতে পারি না । এ তো গেল অর্থহীন কথা ; কিন্তু যে-জোড়া কথার প্রথমাংশ অর্থবিশিষ্ট এবং দ্বিতীয়াংশ বিকৃতি, বাংলায় তাহার প্রধান কর্ণধার টি ব্যঞ্জনবর্ণটি । ইনি একেবারে সরকারীভাবে নিযুক্ত ; জলটল কথাটথা গিয়েটিয়ে কালোটালো ইত্যাদি বিশেষ্য বিশেষণ ক্রিয়া কোথাও ইহার অনধিকার নাই । অভিধানে দেখা যায় টি অক্ষরের কথা বড়ো বেশি নাই, কিন্তু বেকার ব্যক্তিকে যেমন পৃথিবীসুদ্ধ লোকের বেগার ঠেলিয়া বেড়াইতে হয় তেমনই বাংলাভাষায় কুঁড়েমিচৰ্চার যেখানে প্রয়োজন সেইখানেই ট-টাকে হাজরে দিতে হয় । . আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, মূলশব্দের বিকৃতিটাকে মূলের পশ্চাতে জুড়িয়া দিয়া বাংলাভাষা একটা স্পষ্ট অর্থের সঙ্গে অনেকখানি ঝাপসা অর্থ ইশারায় সারিয়া দেয় ; জলটল গানটান তাহার দৃষ্টান্ত । এই সরকারী ট-এর পরিবর্তে এক-এক সময় ফ্য একটিনি করিতে আসে, কিন্তু তাহাতে একটা অবজ্ঞার ভাব আনে ; যদি বলি লুচিটুচি তবে লুচির সঙ্গে কচুরি নিমকি প্রভৃতি অনেক উপাদেয় পদাৰ্থ বুঝাইবার আটক নাই, কিন্তু লুচিফুচি বলিলে লুচির সঙ্গে লোভনীয়তার সম্পর্কমাত্র থাকে না। আর দুটি অক্ষর আছে, স এবং ম্য। বিশেষভাবে কেবল কয়েকটি শব্দেই ইহাদের প্রয়ােগ হয়। স-এর দৃষ্টান্ত : জো-সো জড়োসড়ো মোটাসোটা রকম-সকম ব্যামোস্যামো ব্যারাম-স্যারাম বোকাসোকা নরম-সরম বুড়োসুড়ো আঁটসটি গুটিয়ে-সুটিয়ে বুঝে সুঝে । ম-এর দৃষ্টান্ত : চটেমটে রেগেমেগে হিঁচকে-মিচকে সিটিকে-মিটকে চটকে-মটকে চমকে-মমকে চেচিয়ে-মেচিয়ে আঁৎকে-মাৎকে জড়িয়ে-মাড়িয়ে আঁচড়ে-মাচড়ে শুকিয়ে-মুকিয়ে কুঁচকে-মুচকে দেখা যাইতেছে ম-এর দৃষ্টান্তগুলি বেশ সাধু শান্ত ভাবের নহে, কিছু রুক্ষ রকমের। বোধ হয় চিন্তা করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে, সচরাচর কথাতেও আমরা মা অক্ষরটাকে ট-এর পরিবর্তে ব্যবহার করি, অন্তত ব্যবহার করিলে কানে লাগে না, কিন্তু সে-সকল জায়গায় ম আপনার মেজাজটুকু প্ৰকাশ করে । আমরা বিষ-মিষ বলিতে পারি। কিন্তু সন্দেশ-মন্দেশ যদি বলি তবে সন্দেশের গীেরবটুকু একেবারে নষ্ট হইয়া যাইবে । দুটাে ঘুষোমুষো লাগিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে, এ কথা বলা চলে, কিন্তু বন্ধুকে যত্নমত্ব বা গরিবকে দানমান করা উচিত, একেবারে অচল । হিংসে-মিংসে করা যায়, কিন্তু ভক্তিমক্তি করা যায় না ; তেমন তেমন স্থলে খোচা-মোচা দেওয়া যায়। কিন্তু আদর-মাদর নিষিদ্ধ। অতএব ট-এর ন্যায়। ফ