পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব -V8S ও মা প্ৰশান্ত নিরপেক্ষ স্বভাবের নহে, ইহা নিশ্চয় । তার পরে, কতকগুলি বিশেষ কথার বিশেষ বিকৃতি প্রচলিত আছে। সেগুলি সেই কথারই সম্পত্তি ; যেমন পড়েহড়ে বেছেগুছে মিলেজুলে খেয়েদেয়ে মিশেগুশে সেজোগুজে মেখেচুখে জুটেপুটে লুটেপুটে চুকেবুকে বকেবাকে । এইগুলি বিশেষ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত । । উল্লিখিত তালিকাটি ক্রিয়াপদের । এখানে বিশেষ্য পদেরও দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে ; কাপড় চোপড় আশপাশ বাসন-কোসন রসকস রাবন্দাব গিন্নিবান্নি তাড়াহুড়ো চোটপাট চাকর-বাকর হাঁড়িকুড়ি’ ফাকি জুকি আঁকজোক এলাগোলা এলোথোলো বেঁটে-খেটে খাবার-দাবার ছুতোনাতা চাষাভুষো অন্ধিসন্ধি আলিগলি হাবুডুবু নড়বড় হুলস্থূল । এই দৃষ্টান্তগুলির গুটিকয়েক কথার একটা উলটাপালটা দেখা যায় ; বিকৃতিটা আগে এবং মূলশব্দটা পরে, যেমন : আশপােশ অন্ধিসন্ধি আলিগলি হাবুডুবু হুলস্থূল । উল্লিখিত তালিকার প্রথমার্ধের শেষ অক্ষরের সহিত শেষার্ধের শেষ অক্ষরের মিল পাওয়া যায় । কতকগুলি কথা আছে যেখানে সে-মিলটুকুও নাই ; যেমন : দৌড়ধাপ পুঁজিপাটা কান্নাকাটি তিতিবিরক্ত । ቴ এইবার আমরা ক্ৰমে ক্রমে একটা জায়গায় আসিয়া পৌছিতেছি যেখানে জোড়া শব্দের দুইটি অংশই অর্থবিশিষ্ট । সে স্থলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মানুসারে তাহাকে সমাসের কোঠায় ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু কেন যে তাহা সম্ভবপর নহে দৃষ্টান্তের দ্বারা তাহা বােঝানাে যাক। ছাইভস্ম কালিকিষ্টি লজ্জাশরম প্রভৃতি জোড়া কথার দুই অংশের একই অর্থ ; এ কেবল জোড় দিবার জন্য কথাগুলাকে গালভরা করিয়া তোলা হইয়াছে। এইরূপ সম্পূর্ণ সমার্থক বা প্রায়-সমর্থক জোড়াশব্দের তালিকা দেওয়া গেল : চিঠিপত্র লোকজন ব্যাবসা-বাণিজ্য দুঃখধান্দা ছাইপাশ ছাইভষ্ম মাথামুণ্ডু কাজকর্ম ক্রিয়াকর্ম ছোটােখাটাে ছেলেপুলে ছেলে-ছোকরা খড়কুটাে সাদাসিধে জাক-জমক বসবাস সাফ-সুৎরো । ত্যাড়াবাকা পাহাড়-পর্বত মাপজোখ সাজসজা লজ্জাশরাম ভয়ডর পাকচক্র ঠাট্টা-তামাশা ইশারা-ইঙ্গিত পাখি-পাখালি জন্তু-জানোয়ার মামলা-মকদ্দমা গা-গতর খবর-বার্তা অসুখ-বিসুখ গোনা-গুনতি ভর-ভরতি কঙাল-গরিব গরিবদুঃখী গরিব-গুরবাে। রাজা-রাজড়া খাটপালং বাজনা-বাদ্য কালিকিষ্টি দয়ামায়া মায়া-মমতা ঠাকুর-দেবতা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য চালাক-চতুর শক্ত-সমর্থ গালি-গালাজ ভাবনা-চিন্তে ধর-পাকড় টানা-হ্যাচড়া বাধা ছাদা নাচাকোদা বলা-কওয়া করােকর্ম। " এমন কতকগুলি কথা আছে যাহার দুই অংশের কোনো অর্থসামঞ্জস্য পাওয়া যায় না ; যেমন : মেগেপেতে কেঁদে কেটে বেয়েছেয়ে জুড়ে তেড়ে পুড়েকুড়ে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আগেভাগে গালমন্দ পাকে-প্রকারে । বাংলাভাষায় পত্র শব্দযোগে যে-কথাগুলির উৎপত্তি হইয়াছে সেইগুলিকেও এই শ্রেণীভুক্ত করা যাইতে পারে ; কারণ, গহনাপত্র শব্দে গহনা শব্দের সহিত পত্র শব্দের কোনো অর্থসামঞ্জস্য দেখা যায় না। ঐ রূপ, তৈজসপত্র জিনিসপত্র খরচপত্র বিছানাপত্ৰ ঔষধপত্র হিসাবপত্র দেনাপত্র আসবাবপত্র পুঁথিপত্র বিষয়পত্র চোতাপত্ৰ দলিলপত্র এবং খাতাপত্ৰ । ইহাদের মধ্যে কোনো কোনো কথায় পত্ৰ শব্দের কিঞ্চিৎ সার্থকতা পাওয়া যায়, কিন্তু অনেক স্থলে নয় । ১ সংস্কৃতভাষায় কুণ্ডি শব্দের অর্থ পত্রবিশেষ, সম্ভবত ইহা হইতে হাঁড়িকুড়ি শব্দের কুঁড়ি উৎপন্ন ; এই সকল তালিকার মধ্যে এমন আরো থাকিতে পারে যে-স্থলে এই দোসর শব্দগুলিকে অর্থহীনের কোঠায় ফেলা চলিবে ୩ । ২ছুতোনাত শব্দে ছুতা কী নিয়ম অনুসারে ছুতো হইয়াছে এবং চাষাভূষা শব্দের ভুষা কী কারণে ভুযো হইল পূর্বেই তাহা বলিয়াছি।