পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७४५ রবীন্দ্র রচনাবলী আমরা যে শাস্ত্ৰ হইতে বাদসাদ দিয়া কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দেশানুরাগে কথঞ্চিৎ অন্ধ হইয়া আপন ঘরগড়া মতকে প্রাচীন বলিয়া প্ৰতিপন্ন করি, এখানে তাহার দুই-একটি উদাহরণ দিতে চাই। শ্রদ্ধাস্পদ শ্ৰীযুক্ত চন্দ্রনাথ বসু পরম ভাবুক জ্ঞানবান ও সহৃদয় । তাহার শকুন্তলাসমালোচন তাহার আশ্চর্য প্রতিভার পরিচয় দিয়াছে। আমি যতদূর জানি বাংলায় এরূপ গ্ৰন্থ আর নাই। বাংলার পাঠকসাধারণে চন্দ্রনাথবাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। এইজন্য কিছুকাল হইল তিনি ‘হিন্দুপত্নী” এবং “হিন্দুবিবাহের বয়স ও উদ্দেশ্য” নামে যে-দুই প্ৰবন্ধ প্রচার করেন তাহা সাধারণ্যে অতিশয় আদৃত হইয়াছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি হিন্দুবিবাহের আধ্যাত্মিকতা ও হিন্দুদম্পতির একীকরণত সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা আজকাল গুটিকতক কাগজে অবিশ্রান্ত প্রতিধ্বনিত হইতেছে। ইনি উক্ত প্রবন্ধদ্বয়ে হিন্দুবিবাহ এবং তাহার আনুষঙ্গিকস্বরূপে বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে যতটা বলিয়াছেন, তাহার পরবতী আর কেহ ততটা বলেন নাই। খ্যাতনামা গুণী ও গুণজ্ঞ লেখক শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়কুমার সরকার মহাশয় চন্দ্রনাথবাবুর বিবাহ প্ৰবন্ধের উল্লেখ করিয়া বলেন, “হিন্দুবিবাহের ওরূপ পরিষ্কার ব্যাখ্যা আর কোথাও নাই ।” অতএব উক্ত সর্বজনমান্য প্রবন্ধদ্বয়কে মুখ্যত অবলম্বন করিয়া আমি বর্তমান প্ৰবন্ধ রচনা করিয়াছি, এবং এই উপলক্ষে আমার মতামত যথাসাধ্য ব্যক্ত করিয়াছি।” চন্দ্রনাথবাবু তাহার “হিন্দুপত্নী প্ৰবন্ধে বলিয়াছেন : খ্ৰীষ্টধর্মের আবির্ভাবের বহুপূর্বে ভারতে হিন্দুজাতি স্ত্রীজাতিকে অতি উৎকৃষ্ট ও মাননীয় বলিয়া বুঝিয়েছিল এবং অপর দেশে খ্ৰীষ্টধর্ম স্ত্রীজাতিকে যত উচ্চ করিয়া তুলিয়াছিল ভারতের হিন্দু ভারতের স্ত্রীকে তদপেক্ষা অনেক উচ্চ আসনে বসাইয়াছিল। খ্ৰীষ্টধর্ম স্ত্রীকে পুরুষের সমান করিয়াছিল ; হিন্দুধর্ম স্ত্রীকে পুরুষের সমান করে নাই, পুরুষের দেবতা করিয়াছিল। “যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ (’ যেখানে নারী পূজিতা হন সেখানে দেবতা সন্তুষ্ট হন । প্ৰাচীন কালে স্ত্রীলোকের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহা আমি বলিতে পারি না, কারণ আমি সংস্কৃতভাষায় ব্যুৎপন্ন নাহি এবং আমার শাস্ত্ৰজ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে নাই। কিন্তু আজকাল মুখে ও লেখায় ও অনুবাদে শাস্ত্ৰচৰ্চা দেশে এতটুকু ব্যাপ্ত হইয়াছে যে, শাস্ত্ৰসম্বন্ধে কথঞ্চিৎ আলোচনা করিবার অধিকার অনেকেরই জন্মিয়াছে। চন্দ্রনাথবাবুর মত সত্য কি মিথ্যা তাহা সাহস করিয়া বলিতে পারি না, কিন্তু এটুকু বলিতে পারি যে, চন্দ্রনাথবাবু তাহার মত ভালোরূপ প্রমাণ করিতে পারেন নাই। তিনি যেমন দুই-একটি শ্লোক আপন মতের স্বপক্ষে উদ্ধৃত করিয়াছেন, আমিও তেমনই অনেকগুলি শ্লোক র্তাহার মতের বিপক্ষে উদ্ধৃত করিতে পারি। কিন্তু মনুসংহিতায় স্ত্রীনিন্দাবাচক যে-সকল শ্লোক আছে তাহা উদ্ধৃত করিতে লজ্জা ও কষ্ট বোধ হয়। র্যাহারা জানিতে চাহেন তাহারা মনুসংহিতার নবম ১। এইখানে বলা আবশ্যক, চন্দ্রনাথবাবু যখন বিবাহ সম্বন্ধে তাহার প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন তুখন এ বিষয়ে আন্দােলন কিছুই ছিল না। সুতরাং বিবাহের সমস্ত দিক আলোচনা তেমন আবশ্যক ছিল না। তখন সহৃদয় কল্পনার দ্বারা নীত হইয়া হিন্দুবিবাহের কোনাে একরূপ বিশেষ ব্যাখ্যা করা আশ্চর্য নহে ; ইহাতে সাহিত্যের অধিকার আছে। কিন্তু আজকাল বিষয়টি যেরূপ হইয়া দাড়াইয়াছে, তাহাতে ইহাকে কেবল সাহিত্যের হিসাবে দেখিলে আর চলে না। এইজন্য সাহিত্যের কল্পনাপূর্ণ ভাষা ও ভাবকে অনুসন্ধান ও যুক্তির দ্বারা নির্মমভাবে ভাঙিয়া দেখিতে হইতেছে। বর্তমান আন্দোলন যদি চন্দ্রনাথবাবু পূর্ব হইতে জানিতে পারিতেন। তবে তাহার প্রবন্ধ আর-একরূপ হইত। তাহা হইলে তাহার প্রবন্ধে সাহিত্যরস অপেক্ষাকৃত অল্প থাকিত এবং তিনি তাহার বিষয়টিকে একমাত্র যুক্তির সাহায্যে দুৰ্গম পথের মধ্য দিয়া অতি সাবধানে লইয়া যাইতেন। তিনি যে বিবাহের কথা বলিয়াছেন তাহা সমাজের কোনো কাল্পনিক অবস্থায় ঘটিলেও ঘটিতে পারিত, কিন্তু আজকাল যে আন্দোলন উঠিয়াছে তাহা ভালোমন্দ পরিপূর্ণ সমাজের প্রাত্যহিক বিবাহ লইয়া কিন্তু তাহার উক্ত সাহিত্য সমালোচনা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে চন্দ্রনাথবাবুর দােষ নাই এবং আমারও দোষ নাই-ঘটনাক্রমেই