পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\۹ O রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ঘটে তাঁহা নহে। স্বামী চায় মনের মতো স্ত্রী। তাঁহারই বিশেষ গ্ৰীতিকর রূপগুণসম্পন্ন । স্ত্রী নইলে কেবল অভ্যস্ত-গৃহকাৰ্যনিষ্ঠা স্ত্রী লইয়া তাহার সম্পূর্ণ বাসনা তৃপ্ত হয় না। মনুষ্যের যে কেবল একমাত্ৰ গাৰ্হস্থ্য শৃঙ্খলার প্রতিই দৃষ্টি আছে তাহা নহে। তাহার সৌন্দর্যের প্রতি স্পাহা, কলাবিদ্যার প্রতি অনুরাগ, এবং লোকবিশেষে কতকগুলি বিশেষ মানসিক ও নৈতিকগুণের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে। এইজন্য রুচি-অনুসারে স্বভাবতই মানুষ সৌন্দর্য সংগীত প্রভৃতি কলাবিদ্যা এবং আপন মনের গতি-অনুযায়ী বিশেষ কতকগুলি মানসিক ও নৈতিক গুণ স্ত্রীর নিকট হইতে অনুসন্ধান করিয়া থাকে । স্ত্রীতে তাহার অভাব দেখিলে হৃদয় অপরিতৃপ্ত থাকিয়া যায়। সেরূপ স্থলে অনেক পুরুষ হতাশ হইয়া বারাঙ্গনাসক্ত হয় এবং অনেক পুরুষ দাম্পত্যসুখে বঞ্চিত হইয়া মনের অসুখে স্ত্রীর প্রতি ঠিক ন্যায্য ব্যবহার করিতে পারে না । ইহা তো অনেক স্থলেই দেখা যায় স্ত্রী অভ্যাসমত গৃহকোণে আপনমনে নিত্যগৃহকাৰ্য স্নানমুখে সম্পন্ন করিতেছে, স্বামীর তাহার প্রতি লক্ষই নাই, আদর নাই, যত্ন নাই। কেহ কেহ বলিবেন আধুনিক শিক্ষিতসমাজের মধ্যেই এরূপ ঘটিতেছে, পূর্বে এতটা ছিল না। এ কথা অসংগত নহে। পূর্বে আমাদের মনে সকল বিষয়েই যে একটি সন্তোষ ছিল, ইংরেজিশিক্ষায় তাহা দূর করিয়া দিয়াছে। ইংরেজের দৃষ্টান্তে ও শিক্ষায় বাঙালির মনে কিয়ৎপরিমাণে উদ্যমের সঞ্চার হইয়াছে। এখন আমরা সকল বিষয়েই অদৃষ্ট্রের হাত দেখিয়া আপন হাত গুটািইয়া লইতে পারি না। এইজন্য কোনো অভাব বোধ করিলে সকল সময়ে অদৃষ্টকে ধিককার না দিয়া আপনাকেই ধিককার দিই। ; ইহাই অসন্তোষ । আমাদের আকাঙক্ষাবেগ পূর্বাপেক্ষা বাড়িয়ছে, এবং আগে অনেক কিছু যাহা অনুভব করিতাম না এখন তাহা অনুভব করিয়া থাকি । অতএব আকাঙক্ষাও বাড়িয়াছে, এবং আকাঙক্ষাতৃপ্তিসাধনের উদ্দেশ্যে উদ্যমও বাড়িয়াছে। অতএব এ কথা যদি সত্য হয় যে, আধুনিক স্বভাববিরুদ্ধ কিছু ঘটিয়াছে এমন বলিতে পারি না। অনেকে বলিবেন এরূপ যাহাতে না হয়, প্রাচীন সন্তোষ যাহাতে ফিরিয়া আসে, এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত। কিন্তু ব্ৰহ্মচর্যাদি আশ্রম গ্রহণ করিয়া প্রাচীন কালে পুরুষের প্রতি যে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল, এখন সে-শিক্ষাপ্রণালী আর ফিরিয়া আসিতে পারে না । আমরা যে-শিক্ষার দায়ে পড়িয়াছি তাহা লইয়াই বিব্রত, কারণ তাহার সহিত পেটের দায় জড়িত । চারি দিকের অবস্থা আলোচনা করিয়া মনে করিয়া লইতে হইবে এ শিক্ষা এখন অনেক কাল চলিবেই। অতএব এ শিক্ষার প্রত্যক্ষ এবং অলক্ষ্য প্রভাব উত্তরোত্তর বাড়িবে বৈ কমিবে না। সুতরাং সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান সমালোচন করিবার সময় এ শিক্ষাকে একেবারেই আমল না দিলে চলিবে কেন । সমাজে যে-শিক্ষা প্ৰচলিত নাই তাহারই ফলাফল বিচার করিয়া, এবং যে-শিক্ষা প্ৰচলিত আছে তাহাকে দূরে রাখিয়া কোনো সমাজনিয়ম স্থাপন করা যায় না । বিবাহ সম্বন্ধে ইংরেজিশিক্ষার কী প্রভাব তাহা আলোচনা আবশ্যক । পুরুষ শাস্ত্ৰচৰ্চাবান এবং স্ত্রী শাস্ত্ৰচৰ্চাহীন মন্ত্রহীন হয়, ইংরেজি মতে ইহা প্রার্থনীয় নহে। বিবাহে স্ত্রীপুরুষের একীকরণ ইংরেজি বিবাহের উচ্চ আদর্শ। কিন্তু সে-একীকরণ সর্বাঙ্গীণ একীকরণ- কেবল সাংসারিক একীকরণ নহে, মানসিক একীকরণ । স্বামী যদি বিদ্বান হয় এবং স্ত্রী যদি মুর্থ হয় তবে উভয়ের মধ্যে মানসিক একীকরণ সম্ভবে না, পরস্পরের মধ্যে সম্যক ভাবগ্ৰহ চলিতে পারে না। একটি প্রধান বিষয়ে স্ত্রী পুরুষ পরম্পরের মধ্যে অলঙঘ্য ব্যবধান থাকে । জীবনের সমুদয় কর্তব্যসাধনে স্ত্রীর সহযোগিতা, ইহাও ইংরেজি বিবাহের আদর্শ। এ সম্বন্ধে পূর্বেই বলিয়াছি ; এবং ইহাও বলিয়াছি। এরাপ মহৎ উদ্দেশ্যে মিলন ঘরে প্রস্তুত করিয়া লওয়া যায় না | চৈতন্যের সহিত নিত্যানন্দের, যিশু খৃস্টের সহিত সেন্ট পলের, রামের সহিত লক্ষ্মণের যেরূপ অনিবাৰ্য স্বাভাবিক মিলন ঘটিয়াছিল, ইহাতেও সেইরূপ হওয়া আবশ্যক। ইংরেজি সকল বিবাহে যে এরূপ ঘটিয়া থাকে তাহা নহে, কিন্তু এইরূপ বিবাহই তাঁহাদের আদর্শ। - র্যাহারা বলেন হিন্দুবিবাহের এইরূপ আদর্শ, তাহদের কথা প্রমাণাভাবে এখনো মানিতে পারি না । হিন্দুবিবাহে মনে মনে, প্ৰাণে প্রাণে, আত্মীয় আত্মীয় মিলন ঘটিয়া থাকে কি না বিচাৰ্য। আমরা স্ত্রীকে