পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ ७१& পড়িতেছে, সেই অবস্থার দায়েই বাল্যবিবাহ প্ৰথাও দুর্বল হইয়া পড়িতেছে। দায়ে পড়িয়া শাস্ত্ৰবিধি লঙ্ঘনপূর্বক কন্যাকে অনেক বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত রাখা হইয়াছে, ইতিপূর্বে হিন্দুসমাজে এরূপ দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। সমাজে সর্বাপেক্ষা অধিক মান্য কুলীন সম্প্রদায়ের মধ্যেই ইহা প্রচলিত ছিল এবং অনেক স্থলে এখনো আছে। অতএব তেমন দায়ে পড়িলে অল্পে অল্পে কুমারী কন্যার বয়োবৃদ্ধি এখনো অসম্ভব নহে । সমাজ দায়েও পড়িয়াছে এবং অল্পে অল্পে বয়োবৃদ্ধিও আরম্ভ হইয়াছে। র্যাহারা আচার মানিয়া চলেন। তঁহাদের মধ্যেও ১৩ বৎসর বয়সে কন্যাদান অনেক স্থলে দেখিতে পাওয়া যায় । কিন্তু কিছুকাল পূর্বে আট-দশ বৎসর পার হইলেই কন্যাকে পিতৃগৃহে দেখা যাইত না। পূর্বে কন্যার ৩৪৫ বৎসর বয়সে যত বিবাহ দেখা যাইত এখন তত দেখা যায় না । পুরুষের বিবাহবয়স পূর্বাপেক্ষা অনেক বাড়িয়াছে ইহা প্ৰত্যক্ষ দেখা যাইতেছে। শিক্ষিত হিন্দুসমাজে পুরুষের শিশুবিবাহ নাই বলিলেও হয় । এইরূপ অলক্ষিতভাবে বিবাহের বয়োবৃদ্ধি যে ইংরেজিশিক্ষার অব্যবহিত ফল, আমার তাহা বিশ্বাস নহে । অবস্থার অসচ্ছলতাই ইহার প্রধান কারণ। আমার বোধ হয়। বড়োমানুষের ঘরে বাল্যবিবাহ যতটা আছে মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে ততটা নাই। অর্থক্লেশের সময় ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেওয়া বিষম ব্যাপার । সুবিধা করিয়া বিবাহ দিতে অনেক সময় যায়। বিবাহের ব্যয়ভার বহন করিবার জন্য সাংসারিক খরচ বাদে অল্প অল্প করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতে হয়। গৃহস্থ লোকের পক্ষে তাহাতে অনেক সময় চাই । সমাজের সচ্ছল অবস্থায় কন্যাদায়গ্ৰস্তকে লোকে সাহায্য করিত । কিন্তু এখন একপক্ষে খরচ বাড়িয়াছে, অপরপক্ষে সাহায্য কমিয়াছে। এ ছাড়া, ইংরেজিশিক্ষার প্রভাবে অনেক অবিবাহিত যুবক নানা বিবেচনায় চটপট বিবাহকার্য সারিয়া ফেলিতে চান না । ইহাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক যুবক আছেন র্যাহারা যৌবনের স্বাভাবিক উৎসাহে সংকল্প করেন যে, বিবাহ না করিয়া জীবন দেশের কোনো মহৎ কার্যে উৎসর্গ করিব ; অবশেষে বয়োবৃদ্ধি-সহকারে মহৎ কার্যের প্রতি ঔদাসীন্য জন্মিলে হয়তো বিবাহের প্রতি মনোযোগ করেন । অনেকে বিদ্যাশিক্ষার ব্যাঘাত হইবে বলিয়া পঠদ্দশায় বিবাহ করিতে অসম্মত । এবং অনেকে দারিদ্র্যের হাত এড়ানো দুষ্কর হইবে । র্তাহারা জানেন যে, অল্পবয়সে স্ত্রীপুত্রের ভারে অভিভূত হইয়া তেজ বল সাহস সমস্তই হারাইতে হয় । সহস্ৰ অপমান নীরবে সহ্য করিয়া যাইতে হয়, তাহার সমুচিত প্রতিশোধ দিতে ভরসা হয় না। যখন বিদেশীয় প্রভুর নিকট হইতে নিতান্ত হীনজনের ন্যায় অন্যায় লাঞ্ছনা সহ্য করা যায়। তখন গৃহের ক্ষুধিত রুগণ সন্তানের স্নান মুখই মনে পড়ে এবং নীরবে নতশিরে ধৈর্য অবলম্বন করিতে হয় । কাগজে পত্রে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে অনেক লেখনী-আস্ফালন করি, কিন্তু গৃহে ক্ৰন্দনধ্বনি শুনিলে আর থাকা যায় না ; সেই শ্বেতপুরুষের দ্বারস্থ হইয়া জোড়হন্তে ছলছলনয়নে দুই বেলা উমেদারি করিয়া মরিতে হয়। সংসার-ভার বহন করিয়া বাঙালিদের স্বাভাবিক সাবধানতাবৃত্তি চতুর্গুণ বাড়িয়া উঠে এবং সকল দিক বিবেচনা করিয়া কোনো কাজে অগ্রসর হইতে পা উঠে না। এইরূপ ভারাক্রান্ত ভীত এবং ব্যাকুল ভােব জাতির উন্নতির প্রতিকুল তাহার আর সন্দেহ নাই । এ কথা স্মরণ করিয়া অনেক দেশানুরাগী অপমান-অসহিষ্ণু উন্নতস্বভাব যুবক অসমর্থ অবস্থায় বিবাহ করিতে বিরত হইবেন । ইহা নিশ্চয়ই যে, দারিদ্র্যের প্রভাব যতই অনুভব করা যাইবে লোকে বিবাহবন্ধনে ধরা দিতে ততই সংকুচিত হইবে। যখন চারি দিকে দেখা যাইবে উদ্বাহবন্ধন উদ্বন্ধনের ন্যায় বিবাহিতের কণ্ঠদেশ আক্রমণ করিয়াছে, তখন মনু অথবা অন্য কোনো ঋষির বিধান সত্ত্বেও যুবক যখন-তখন উক্ত ফাসের মধ্যে গলা গলাইয়া দিতে সম্মত হইবে না । স্ত্রীর সহিত পবিত্র একত্ব সাধন করিতে গিয়া যদি পঞ্চােত্ব নিকটবতী হয় তবে অনেক বিবেচক লোক উক্ত মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিতে | বিরত হইবেন সন্দেহ নাই। বাপ মায়ে ঠেকিয়া শিখিয়াছেন, তাহারাও যে তাড়াতাড়ি অবিবেচক বালকের গলদেশে বিষম গুরুভার বধু বাধিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবেন, ইহা সম্ভব নহে। ছেলে যখন আপনি উপার্জন করিবে তখন বিবাহ করিবে, আজকাল অনেক পিতার মুখে এ কথা শুনা যায় । এমনকি, হিন্দুগৃহে প্রাচীন নিয়মে পালিতা সেকেলে একটি প্রাচীনার মুখে এই মত শুনিয়া আশ্চর্য ।