পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ولrان করিয়া পবিত্র চরণতলের তৈল জোগাইতে লাগিল। এমন সংযম এমন বদ্ধ নিয়ম, এমন নিরামিষ সাত্ত্বিকতার দৃষ্টান্ত কোথায় পাওয়া যাইবে । আজকাল চােখের ঠুলি খুলিয়া অনেকে ঘানি-প্ৰদক্ষিণের পবিত্ৰ নিগুঢ়তত্ত্ব ভুলিয়া যাইতেছে। কী আক্ষেপের বিষয় । এক হিসাবে শঙ্করাচার্যের আধুনিক ভারতবর্ষকেই প্ৰাচীন ভারতবর্ষ বলা যাইতে পারে ; কারণ, ভারতবর্ষ তখন এমনই জরাগ্রস্ত হইয়াছে যে, তাহার জীবনের লক্ষণ আর বড়ো নাই। সেই মৃতপ্ৰায় সমাজকে শুভ্ৰ আধ্যাত্মিক বিশেষণে সজিত করিয়া তাহাকেই আমাদের আদর্শস্থল বলিয়া প্রচার করিতেছি, তাহার কারণ, আমাদের সহিত তাহার তেমন অনৈক্য নাই । কিন্তু মহাভারতের মহাভারতবর্ষকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে যে-প্রচণ্ড বীৰ্য, বিপুল উদ্যমের আবশ্যক তাহা কেবলমাত্র নিরামিষ ও সাত্ত্বিক নহে, অর্থাৎ কেবলমাত্র ব্ৰাহ্মণ অধ্যাপকের আবাদ করিলে সে ভারতবর্ষ উৎপন্ন হইবে না। আহারের সহিত আত্মার যোগ আর-কোনো দেশ আবিষ্কার করিতে পারিয়াছিল কি না জানি না কিন্তু প্ৰাচীন যুরোপের যাজকসম্প্রদায়ের মধ্যেও আহারব্যবহার এবং জীবনযাত্ৰা কঠিন নিয়মের দ্বারা সংযত ছিল। কিন্তু সেই উপবাসকৃশ যাজকসম্প্রদায়ই কী প্রাচীন যুরোপ। তখনকার যুরোপীয় ক্ষত্ৰিয়মণ্ডলীও কি ছিল না। এইরূপ বিপরীত শক্তির ঐক্যই কি সমাজের প্রকৃত জীবন নহে। কোনাে বিশেষ আহারে আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধি পায় বলিতে কী বুঝায়।— মনুষ্যের মধ্যে যে-একটি কর্তৃশক্তি আছে, যে-শক্তি স্থায়ী সুখের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ক্ষণিক সুখ বিসর্জন করে, ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি করিয়া বর্তমানকে চালিত করে, সংসারের কার্যনির্বাহাৰ্থ আমাদের যে-সকল প্রবৃত্তি আছে প্রভুর ন্যায় তাহাদিগকে যথাপথে নিয়োগ করে, তাহাকেই যদি আধ্যাত্মিক শক্তি বলে তবে স্বল্পাহারে বা বিশেষ আহারে সেই শক্তি বৃদ্ধি হয় কী করিয়া আলোচনা করিয়া দেখা যাক । খাদ্যরসের সহিত আত্মার যোগ কোথায়, এবং আহারের অন্তর্গত কোন কোন উপাদান বিশেষরূপে আধ্যাত্মিক ; বিজ্ঞানে তাহা এ পর্যন্ত নির্দিষ্ট হয় নাই । যদি তৎসম্বন্ধে কোনো রহস্য শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতদিগের গোচর হইয়া থাকে, তবে অক্ষম গুরুপুরোহিতের প্রতি ভারাপণ না করিয়া চন্দ্রনাথবাবু নিজে তাহা প্ৰকাশ করিলে আজিকার এই নব্য পাশবাচারের দিনে বিশেষ উপকারে আসিত । এ কথা সত্য বটে স্বল্পাহার এবং অনাহার প্রবৃত্তিনাশের একটি উপায় । সকল প্রকার নিবৃত্তির এমন সরল পথ আর নাই। কিন্তু প্ৰবৃত্তিকে বিনাশ করার নামই যে আধ্যাত্মিক শক্তির বৃদ্ধিসাধন তাহা କn(୧) । মনে করো, প্রভুর নিয়োগক্রমে লোকাকীর্ণ রাজপথে আমাকে চার ঘোড়ার গাড়ি হাকাইয়া চলিতে হয় । কাজটা খুব শক্ত হইতে পারে। কিন্তু ঘোড়াগুলার দানা বন্ধ করিয়া তাহাদিগকে আধমরা করিয়া রাখিলে কেবল ঘোড়ার চলৎশক্তি কমিবে, কিন্তু তাহাতে যে আমার সারথ্যশক্তি বাড়িবে এমন কেহ। বলিতে পারে না । ঘোড়াকে যদি তোমার শত্রুই স্থির করিয়া থাক তবে রথযাত্ৰাটা একেবারে বন্ধই রাখিতে হয়। প্রবৃত্তিকে যদি রিপু জ্ঞান করিয়া থাক তবে শত্রুহীন হইতে গেলে আত্মহত্যা করা আবশ্যক, কিন্তু তদ্দ্বারা আধ্যাত্মিক শক্তি বাড়ে কি না তাহার প্রমাণ দুস্তপ্ৰাপ্য। গীতায় “শ্ৰীকৃষ্ণ কর্মকে মনুষ্যের শ্রেষ্ঠপথ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছেন।” তাহার কারণ কী । তাহার কারণ এই যে, কর্মেই মনুষ্যের কর্তৃশক্তি বা আধ্যাত্মিকতার বলবৃদ্ধি হয়। কর্মেই মনুষ্যের সমুদয় । প্রবৃত্তি পরিচালনা করিতে হয় এবং সংযত করিতেও হয়। কর্ম যতই বিচিত্র, বৃহৎ এবং প্রবল, - আত্মনিয়োগ এবং আত্মসংযমের চর্চা ততই অধিক । এঞ্জিনের পক্ষে বাস্প যেমন, কর্মানুষ্ঠানের পক্ষে প্ৰবৃত্তি সেইরূপ । এঞ্জিনে যেমন এক দিকে ক্রমাগত কয়লার খোরাক দিয়া আগ্নেয় শক্তি উত্তেজিত করিয়া তোলা হইতেছে আর-এক দিকে তেমনি দুর্ভেদ্য লোহাবল তাহাকে গ্রহণ ও ধারণ করিয়া স্বকার্যে নিয়োগ করিতেছে, মনুষ্যের জীবনযাত্ৰাও সেইরূপ । সমস্ত আগুন নিবাইয়া দিয়া সাত্ত্বিক ঠাণ্ডা জলের মধ্যে শীতকালের সরীসৃপের মতাে নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকাকেই যদি মুক্তির উপায় বল। তবে সে এক স্বতন্ত্র