পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ ܠ ܟܠ ইহাতেই নির্ধনের আন্তরিক অসন্তোষ প্রতিদিন বাড়িয়া উঠিতেছে, তাহার কাজের সুখ নাই। সে আপনার মনুষ্যত্ব খাটাইতে পারে না । । বিলাসী রোম একসময়ে অসভ্য বিদেশীকে আপনাদের সেনারূপে নিযুক্ত করিয়াছিল । যুরোপের শূদ্রদল যদি বিদ্রোহী হইয়া কখনো কর্মে জবাব দেয়, পূর্ব হইতে জানাইয়া রাখা ভালো, আমরা উমেদার আছি । - আমরা কলের কাজ করিবার জন্য একেবারে কলে তৈয়ারি হইয়াছি। মনু পরাশর ভৃগু নারদ সকলে মিলিয়া আমাদের আত্মকর্তৃত্ব চূৰ্ণ করিয়া দিয়াছেন ; পশুর মতো নিজের স্বাভাবিক চক্ষুতে ঠুলি আমাদিগকে যন্ত্রে জুতিয়া দিলেই হইল। শরীর কাহিল বটে, যন্ত্রের তাড়নায় প্রাণান্ত হইতে পারে, কিন্তু কখনো বিদ্রোহী হইব না । কখনো এমন স্বপ্নেও মনে করিব না যে, স্বাধীন চেষ্টার দ্বারা আমাদের এ অবস্থার কোনো প্ৰতিকার হইতে পারে । কর্মে আমাদের অনুরাগ নাই । বৈরাগ্যমন্ত্র কানে দিয়া সেটুকু জীবনলক্ষণও আমাদের রাখা হয় নাই । কিন্তু তাহাতে কলের কাজের কোনো ব্যাঘাত হইবে না, বরং সুবিধা হইবে। কেননা কর্মে যাহাদের প্রকৃত অনুরাগ আছে তাহারা সহিষ্ণুতা সহকারে কলের কাজ করিতে পারে না। কারণ, যাহারা কর্তৃত্ব অনুভব করিয়া সুখ পায় তাহারাই কর্মের অনুরাগী। উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষে বাধা অতিক্রম করিয়া একটা কাৰ্য সমাধাপূর্বক তাহারা আপনারই স্বাধীনতা উপলব্ধি করে, সে-ই তাঁহাদের আনন্দ । কিন্তু সেরাপ কর্মানুরাগী লোক কলের কাজ করিয়া সুখী হয় না, কারণ কলের কাজে কেবল কাজের দুঃখ আছে অথচ কাজের সুখটুকু নাই ! তাহাতে স্বাধীনতা নাই। কোনো কর্মপ্ৰিয় লোক ঘানির গোরু কিংবা স্যাকারাগাড়ির ঘোড়া হইতে চাহে না । কিন্তু যাহার কর্মে অনুরাগ দূর হইয়া গেছে তাহাকে এরূপ কাজে লাগাইলে ললাটের লিখন স্মরণ করিয়া বিনা উপদ্রবে। সে কাজ করিয়া যায় । মাঝে ইংরেজি শিক্ষায় আমাদের মনে ঈষৎ চাঞ্চল্য আনয়ন করিয়াছিল । বহুদিবসের পিঞ্জীরবদ্ধ বিহঙ্গের মনে মুক্ত আকাশ এবং স্বাধীন নীড়ের কথা উদয় হইয়াছিল। কিন্তু আমাদের জ্ঞানী লোকেরা সম্প্রতি বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, এরূপ চাঞ্চল্য পবিত্র হিন্দুদিগকে শোভা পায় না। র্তাহারা উপদেশ দেন, অদৃষ্টবাদ অতি পবিত্র, কারণ তাঁহাতে স্বাধীন চেষ্টাকে যথাসম্ভব দূর করিয়া দেয়। সর্ববিষয়ে শাস্ত্রানুশাসন অতি পবিত্র, কারণ তাঁহাতে স্বাধীন বুদ্ধিকে অকৰ্মণ্য করিয়া রাখে । আমাদের যাহা আছে তাহাই সর্বাপেক্ষা পবিত্র, কারণ এ কথা স্মরণ রাখিলে স্বাধীন বুদ্ধি এবং স্বাধীন চেষ্টাকে একেবারেই জবাব দেওয়া যাইতে পারে। বোধ হয় এই সকল জ্ঞানগর্ভ কথা সাধারণের খুব হৃদয়গ্ৰাহী হইবে, বহুকাল হইতে হাদয় এইভাবেই প্ৰস্তুত হইয়া আছে । যন্ত্রবিজ্ঞানের উন্নতি-সহকারে যন্ত্র যতই সম্পূর্ণ হইবে তাহা চালনা করিতে মানুষের বুদ্ধির আবশ্যক ততই হ্রাস হইয়া আসিবে, এবং স্বাধীনবুদ্ধিসম্পন্ন জীবের পক্ষে সে কাজ ততই অসহ্য হইয়া উঠিবে। আশা আছে, ভারতবষীয়দের বিশেষ উপযোগিতা তখনই য়ুরোপ বুঝিতে পরিবে। যাহারা মান্ধাতার যেখানে পড়ে সেইখানে পড়িয়া থাকাকেই পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ গৌরবের বিষয় বলিয়া গর্ব করে, আবশ্যক হইলে তাহারাই সহিষ্ণুভাবে নতশিরে সমস্ত যুরোপের কল টানিতে পরিবে। যদি বরাবর। পবিত্র আর্যশিক্ষাই জয়ী হয় তবে আমাদের প্রপৌত্রদিগের চাকরির জন্য বােধ হয় আমাদের পৌত্ৰাদিগকে অধিক ভাবিতে হইবে না । w S Sabr