পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমাদেরও কতকটা সেই অবস্থা। ইংরেজ ফরাসী গ্ৰীক লাটিন ইহারা তো আমাদের খুড়তুতো ভাই, এখন ইহুদি মুসলমানেরাও যদি আমাদের আপনার হইয়া যায় তাহা হইলে পৃথিবীতে আমাদের আত্মীয়গীেরবের তুলনা মিলে না। তাহা হইলে আমাদের আর্যমাতার প্রথম-জাত এই অজ্ঞাত পুত্ৰ কর্ণও আমাদের চিরবৈরীশ্রেণী হইতে কুটুম্বশ্রেণীতে ভুক্ত হন। i > ૨છે જે আদিম সম্বল যে জাতি নূতন জীবন আরম্ভ করিতেছে তাহার বিশ্বাসের বল থাকা চাই। বিশ্বাস বলিতে কতকগুলা অমূলক বিশ্বাস কিংবা গোড়ামির কথা বলি না। কিন্তু কতকগুলি ধ্রুব সত্য আছে, যাহা সকল জাতিরই জীবনের মূলধন, যাহা চিরদিনের পৈতৃক সম্পত্তি ; এবং যাহা অনেক জাতি সাবালক হইয়া উড়াইয়া দেয় অথবা কোনো কাজে না খাটাইয়া মাটির নীচে পুঁতিয়া যক্ষের জিন্মায় সমর্পণ করে । যেমন একটা আছে স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাস ; অর্থাৎ আর-একজন কেহ ঘাড় ধরিয়া আমার কোনো স্থায়ী উপকার করিতে পারে এ কথা কিছুতে মনে লয় না, আমার চোখে ঠুলি দিয়া আর-একজন যে আমাকে মহত্ত্বের পথে লইয়া যাইতে পারে। এ কথা স্বভাবতই অসংগত এবং অসহ্য মনে হয় ; কারণ, যাহাতে মনুষ্যত্বের অপমান হয় তাহা কখনোই উন্নতির পথ হইতে পারে না । আমার যেখানে স্বাভাবিক অধিকার সেখানে আর-একজনের কর্তৃত্ব যে সহ্য করিতে পারে সে আদিম মনুষ্যত্ব হারাইয়াছে । স্বাধীনতাপ্রিয়তা যেমন উক্ত আদিম মনুষ্যত্বের একটি অঙ্গ তেমনই সত্যপ্রিয়তা আর-একটি । ছলনার প্রতি যে একটা ঘূণা, সে ফলাফল বিচার করিয়া নহে, সে একটি সহজ উন্নত সরলতার গুণে । যেমন যুবাপুরুষ সহজে ঋজু হইয়া দাড়াইতে পারে তেমনই স্বভাবসুস্থ যুবক জাতি সহজেই সত্যাচরণ করে । যদিবা কোনো বয়স্ক বিজ্ঞলোক এমন মনে করেন, কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নহে, আমার স্বাভাবিক অধিকার থাকিলেও আমার স্বাভাবিক যোগ্যতা না থাকিতেও পারে, অতএব সেইরূপ স্থলে অধীনতা স্বীকার করাই যুক্তিসংগত ; কথাটা যেমনই প্রামাণিক হউক তবু এ কথা বলিতেই হইবে, যে-জাতির মাথায় এমন যুক্তির উদয় হইয়াছে তাহার যাহা হইবার তাহা হইয়া গেছে। আর যা-ই হউক, জীবনের আরম্ভে এরূপ ভাব কিছুতেই শোভা পায় না। আমার কার্য আমাকেই করিতে হইবে ; আর-একজন করিয়া দিলে কাজ হইতে পারে। কিন্তু আমার ভালো হইবে না । কাজের চেয়ে মানুষ শ্রেষ্ঠ । কলে কাজ হয়। কিন্তু কলে মানুষ হয় না। এইরূপ স্বাভাবিক বিশ্বাস লইয়া যে-জাতি কাজ করিতে আরম্ভ করে সে-ই কাজ করিতে পারে। সে অনেক ভুল করিবে কিন্তু তাহার মানুষ হইবার আশা আছে। । অন্যপক্ষে, যুক্তির চক্ষু উৎপাটন করিয়া, জীবনধর্মের গতিমুখে বাধ বাধিয়া দিয়া, মানুষের স্বাধীনতাসর্বস্ব সম্পূর্ণ বাজেয়াপ্ত করিয়া একটি সমাজকে কলের মতো বানাইয়া তাহা হইতে নির্বিরোধে নিয়মিত কাজ আদায় করিতে পাের, কিন্তু মনুষ্যত্বের দফা নিকাশ। সেখানে চিন্তা যুক্তি আত্মকর্তৃত্ব এবং সেইসঙ্গে ভ্ৰম বিরোধ সংশয় প্রভৃতি মানবের ধর্ম লোপ পাইয়া যাইবে, কেবল কালের ধর্ম, কাজ করা, তাহাঁই চলিতে থাকিবে । কিন্তু নির্ভুল কল এবং ভ্রান্ত মানুষের মধ্যে যদি পছন্দ করিয়া লইতে হয় তবে মানুষকেই বাছিতে হয়। ভ্ৰম হইতে অনেক সময় সত্যের জন্ম হয়, কিন্তু কল হইতে কিছুতেই মানুষ বাহির হয় না । মনুষ্যের সকল প্রকার স্বাধীনতা অপহরণ করিয়া আমাদের সমাজের যে কী আশ্চর্য শৃঙ্খলা