পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vb&V) রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কষ্টভোগ করিতেছে ; অজ্ঞানকৃত কার্যের ফল ইচ্ছাকৃত অপরাধের সমান হইয়া দাড়াইতেছে ; এবং একজন লোকের উৎপীড়ন বা অবিবেচনায় শত সহস্ৰ লোককে দুঃখবহন করিতে হইতেছে। অতএব জগতের নিয়মকে ধর্মনীতির আইন-অনুসারে বিচার করিতে হইলে তাহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিতে হয় । কিন্তু সাহস করিয়া কোনো বিচারক সে রায় প্ৰকাশ করিতে চান না । হিব্রুশাস্ত্র এ সম্বন্ধে চুপ করিয়া থাকেন। ভারতবর্ষ এবং গ্ৰীস আসামীর পক্ষ অবলম্বন করিয়া ওকালতি করিতে চেষ্টা করেন । ভারতবর্ষ বলেন, সকলকেই অসংখ্য পূর্বজন্মপরম্পরার কর্মফল ভোগ করিতে হয়। বিশ্বনিয়মে কোথাও কার্যকরণশঙ্খলের ছেদ নাই ; সুখদুঃখও সেই অনন্ত অমোঘ অবিচ্ছিন্ন নিয়মের বশবর্তী । হিন্দুশাস্ত্ৰমতে পরিবর্তমান বস্তু এবং মনঃপদার্থের অভ্যন্তরে একটি নিত্যসত্তা আছে । জগতের মধ্যবর্তী সেই নিত্যপদার্থের নাম ব্ৰহ্ম এবং জীবের অন্তরস্থিত ধ্রুবসত্তাকে আত্মা কহে। জীবাত্মা কেবল ইন্দ্ৰিয়জ্ঞান বুদ্ধিবাসনা প্রভৃতি মায়া দ্বারা ব্ৰহ্ম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছে। যাহারা অজ্ঞান তাহারা এই মায়াকেই সত্য বলিয়া জানে, এবং সেই ভ্রমবশতই বাসনাপাশে বদ্ধ হইয়া দুঃখের কশাঘাতে জর্জরিত হইতে থাকে । এ মত গ্ৰহণ করিলে অস্তিত্ব হইতে মুক্তিলাভের চেষ্টাই একমাত্র উদ্দেশ্য হইয়া দাড়ায় । বিষয়বাসনা, সমাজবন্ধন, পারিবারিক স্নেহপ্ৰেম, এমন-কি, ক্ষুধাতৃষ্ণা ও ইন্দ্ৰিয়ানুভূতিও বিনাশ করিয়া একপ্রকার সংজ্ঞাহীন জড়ত্বকেই ব্ৰহ্মসম্মিলনের লক্ষণ বলিয়া বিশ্বাস করিতে হয়। বৌদ্ধগণ ব্ৰাহ্মণদিগের এই মত গ্ৰহণ করিয়া সন্তুষ্ট ছিলেন না ; তাহারা আত্মা এবং ব্ৰহ্মের সত্তাও লোপ করিয়া দিলেন । কারণ, কোথাও কোনো অস্তিত্বের লেশমাত্রও স্বীকার করিলে পুনরায় তাহা হইতে দুঃখের অভিব্যক্তি অবশ্যম্ভাবী বলিয়া মানিতে হয়। এমন-কি, হিন্দুশাস্ত্রের নির্গুণ ব্রহ্মের মতো এমন একটা নাস্তিবাচক অস্তিত্বকেও তাহারা কোথাও স্থান দিতে সাহস করিলেন না । বুদ্ধ বলিলেন, বস্তুই বা কী আর মনই বা কী, কিছুর মধ্যেই নিত্যপদার্থ নাই ; অনন্ত বিশ্বমরীচিকা কেবল স্বপ্নপ্রবাহমাত্র । স্বপ্ন দেখিবার বাসনা একবার ধ্বংস করিতে পারিলেই মানুষের মুক্তি হয়, এবং ব্ৰহ্ম ও আত্মা নামক কোনো নিত্যপদার্থ না থাকাতে একবার নির্বাণলাভ করিলে আর দ্বিতীয়বার অস্তিত্ব লাভের সম্ভাবনামাত্র থাকে না । প্রাচীন গ্ৰীসে স্টোয়িক সম্প্রদায় যখন জগৎকারণ ঈশ্বরে অসীম সদগুণের আরোপ করিলেন তখন র্তাহার সৃষ্ট বিশ্বজগতে অমঙ্গলের অস্তিত্ব কিরূপে সম্ভব হইল, ইহাই এক সমস্যা দাড়াইল । র্তাহারা বলিলেন, প্রথমত জগতে অমঙ্গল নাই ; দ্বিতীয়ত যদি-বা থাকে তাহা মঙ্গলেরই আনুষঙ্গিক ; এবং যেটুকু আছে তাহা আমাদের নিজদোষে নয়। আমাদের ভালোরই জন্য । হক্সলি বলেন, অমঙ্গলের মধ্যেও যে মঙ্গলের অস্তিত্ব দেখা যায় তাহাতে সন্দেহ নাই এবং দুঃখ কষ্ট যে অনেক সময় আমাদের শিক্ষকের কার্য করে তাহাও সত্য ; কিন্তু অসংখ্য মূঢ় প্রাণী, যাহারা এই শিক্ষায় কোনো উপকার পায় না এবং যাহাদিগকে কোনো কাজের জন্য দায়িক করা যাইতে পারে না, তাহারা যে কেন দুঃখভোগ করে এবং অনন্তশক্তিমান কেনই-বা সর্বতোভাবে দুঃখপাপহীন করিয়া জগৎসৃজন না করিলেন, স্টোয়িকগণ তাহার কোনো উত্তর দিলেন না । জগতে যাহা-কিছু আছে তাহাই সর্বাপেক্ষা উত্তম, এ কথা স্বীকার করিলে কোথাও কোনো সংশোধনের চেষ্টা না করিয়া সম্পূর্ণ উদাসীন হইয়া বসিয়া থাকাই কর্তব্য হইয়া দাড়ায় । কিন্তু বাহ্যজগৎ যে মানুষের ধর্মশিক্ষাস্থল, সর্বমঙ্গলবাদী স্টোয়িকদের নিকটও তাহা ক্রমশ অপ্রমাণ হইতে লাগিল। কারণ দেখিতে পাওয়া যায়, এক হিসাবে জগৎপ্রকৃতি আমাদের ধর্মপ্রকৃতির বিরোধী । এ সম্বন্ধে হক্সলির মত আর-একটু বিবৃত করিয়া নিম্নে লিখা যাইতেছে। মানুষ জীবনসংগ্রামে জয়ী হইয়া আজ সমস্ত জীবরাজ্যের, সর্বশ্রেষ্ঠপদে অভিষিক্ত হইয়াছে। নিজেকে যেন তেন প্রকারেণ বজায় রাখা, যাহা পাওয়া যায় নির্বিচারে তাহাকে আত্মসাৎ করা এবং যাহা হাতে আসে তাহাকে একান্ত চেষ্টায় রক্ষা করা, ইহাই জীবনযুদ্ধের প্রধান অঙ্গ। যে-সকল গুণের