পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ ዪኃእsዒ প্রভাবে বানর এবং ব্যাঘ্র জীবনরক্ষা করিতেছে সেই সকল গুণ লইয়াই মানুষ জীবনসংগ্রামে প্রবৃত্ত তাহার অনুকরণনৈপুণ্য এবং তাহার ইচ্ছা বাধাপ্রাপ্ত হইলে প্রচণ্ড ক্রোধাবেগে নিষ্ঠুর হিংস্ৰতাই তাহাকে ক্ৰমে আদিম অরাজকতা দূর হইয়া যতই সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপিত হইল ততই মনুষ্যের পাশব গুণগুলি দোষের হইয়া দাড়াইতে লাগিল । সভ্য মানব যে-মই দিয়া উপরে উঠিয়াছে সোঁ-মইটা আজ পদাঘাত করিয়া ফেলিয়া দিতে চাহে। ভিতরে ব্যাঘ্র এবং বানরের যে-অংশটা আছে সেটাকে দূর করিতে পারিলে বঁাচে । কিন্তু সেই ব্যাঘ্ৰবােনরটা সভ্য মানবের সুবিধা বুঝিয়া দূরে যাইতে চাহে না ; সেই কৈশোরের চিরসহচরগুলি অনাদৃত হইয়াও মানবসমাজের মধ্যে অনাহুত আসিয়া পড়ে এবং আমাদের সংযত সামাজিক জীবনে শত সহস্ৰ দুঃখকষ্ট এবং জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে। সেই সনাতন ব্যাঘ্ৰবানর-প্রবৃত্তিগুলাকে মানুষ আজ পাপ বলিয়া দাগ দিয়াছে এবং যাহারা এককালে আমাদিগকে দুরূহ। ভবসংগ্রামে উত্তীর্ণ করিয়াছে তাহাদিগকে বন্ধনে ছেদনে সবংশে বিনাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে । অতএব জগৎপ্ৰকৃতি আমাদের ধর্মপ্রবৃত্তির আনুকূল্য করিতেছে। এ কথা স্বীকার করা যায় না ; বরঞ্চ দেখা যায়, আমাদের ধর্মপ্রবৃত্তির সহিত তাহার অহৰ্নিশি সংগ্রাম চলিতেছে। স্টোয়িকগণও তাহা বুঝিলেন এবং অবশেষে বলিলেন, সংসার ত্যাগ করিয়া সমস্ত মায়ামমতা বিসর্জন দিয়া তবে কিয়ৎপরিমাণে পরিপূর্ণতার আদর্শ লাভ করা যাইতে পারে |Apatheia অর্থাৎ বৈরাগ্য মানবপ্রকৃতির পূর্ণতাসাধনের উপায়। সেই বৈরাগ্যের অবস্থায় মানবহৃদয়ের সমস্ত ইচ্ছা কেবল বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার অনুশাসন পালন করিয়া চলে। সেই স্বল্পাবশিষ্ট চেষ্টাটুকুও কেবল অল্পদিনের জন্য ; সে যেন বিশ্বব্যাপী পরমাত্মারই দেহপিঞ্জরাবদ্ধ একটি উচ্ছাস, মৃত্যু-অন্তে সেই সর্বব্যাপী আত্মার সহিত পুনর্মিলনের প্রয়াস পাইতেছে । দেখা যাইতেছে, ভারতবর্ষ এবং গ্ৰীস ভিন্ন দিক হইতে আরম্ভ করিয়া অবশেষে এক বৈরাগ্যে গিয়া মিলিত হইয়াছে । বৈদিক এবং হােমেরিক কাব্যে আমাদের সম্মুখে যো-জীবনের চিত্র ধরিয়াছে তাহার মধ্যে কী একটা বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য এবং আনন্দপূর্ণ সমরোৎসাহ দেখা যায়- তখন বীরগণ সুখ-দুঃখ, শুভদিনের সূর্যালোক এবং দুদিনের বীজপতন উভয়কেই খেলাচ্ছলে গ্রহণ করিতেন এবং যখন শোণিত উষ্ণ হইয়া উঠিত তখন দেবতাদের সহিত যুদ্ধ করিতেও কুষ্ঠিত হইতেন না। তাহার পরে কয়েক শতাব্দী অতীত হইতেই পরিণত সভ্যতা-প্রভাবে চিন্তাজ্বরে জরাজীর্ণ হইয়া সেই বীরমণ্ডলীর উত্তরপুরুষগণ জগৎসংসারকে দুঃখময় দেখিতে লাগিল। যোদ্ধা হইল তপস্বী, কমী হইল বৈরাগী। গঙ্গাকূলে এবং টাইবর-তীরে নীতিজ্ঞ ব্যক্তি স্বীকার করিলেন বিশ্বসংসার প্রবল শত্রু এবং বিশ্ববন্ধনচ্ছেদনই মুক্তির প্রধান উপায় । প্রাচীন হিন্দু ও গ্ৰীক -দর্শন যেখান হইতে আরম্ভ করিয়াছিল আধুনিক মানবমনও সেইখান হইতেই যাত্রার উপক্ৰম করিতেছে । কিন্তু আধুনিক সমাজে যদিও দুঃখবাদী ও সুখবাদীর অভাব নাই। তথাপি এ কথা স্বীকার করিতে হয়, আমাদের অধিকাংশ লোকই দুই মতের মাঝখান দিয়া চলিয়া থাকেন । মোটের উপর সাধারণের | ধারণা, জগৎটা নিতান্ত সুখেরও নহে নিতান্ত দুঃখেরও নহে। দ্বিতীয়ত, মানুষ যে নিজকৃত কর্মের দ্বারা জীবনের অনেকটা সুখদুঃখের হ্রাসবৃদ্ধি সাধন করিতে পারে এ সম্বন্ধেও অধিকাংশের মতের ঐক্য আছে। তৃতীয়ত, কায়মনোবাক্যে সমাজের মঙ্গলসাধন যে আমাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য এ সম্বন্ধেও লেখক কাহাকেও সন্দেহ প্রকাশ করিতে শোনেন নাই। এক্ষণে বর্তমানকালে প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে আমাদের যে-সকল নুতন জ্ঞান লাভ হইয়াছে, তাহার