পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१०० রবীন্দ্র-রচনাবলী মাটির মানুষ, দেবপ্রতিমা, কিন্তু ভিতরে কোনো চরিত্র নাই, বহুল পরিমাণে খড় আছে। যথার্থ চরিত্র-অগ্নি থাকিলে সেই তৃণনির্মিত নিজীব ভালোমানুষ দগ্ধ হইয়া যায়। ] এই কৃশ খর্বকায় শান্তস্বভাব য়ুরোপীয় যুবকটির অন্তরের মধ্যে যে একটি দীপ্তিমান চরিত্র-অগ্নি উধ্বশিখা হইয়া জ্বলিতেছিল তাহা তাহার প্রথম কার্যেই প্রকাশ পায়। তিনি যে স্বদেশ ছাড়িয়া সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া জন্মভূমি ও আত্মীয়স্বজন হইতে বহুদূরে এই সম্পূর্ণ অপরিচিত পরজাতির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন এই দুঃসাধ্য কার্যে কে তাহাকে প্রবৃত্ত করাইল । কোথায় সেই মেরুতুষারচুম্বিত যুরোপের শীর্ষবিলম্বিত সুইডেন আর কোথায় এই এশিয়ার প্রান্তবতী, খররেদ্রক্লান্ত বঙ্গভূমি। পরস্পরের মধ্যে কোনো সভ্যতার সাম্য, কোনো আত্মীয়তার সম্বন্ধ, কোনো ঐতিহাসিক সংযোগ নাই । ভাষা প্ৰথা অভ্যাস জীবনযাত্রার প্রণালী, সমস্তই স্বতন্ত্র । সমস্ত প্ৰিয়বন্ধন সমস্ত চিরাভ্যস্ত সংস্কার ಜ್ಷ° Fe কোনো ব্যক্তিকে এমন সম্পূর্ণরূপে নির্বািসনদণ্ড বিধান করিতে পারে না। সন্দেহ । কলিকাতায় বাঙালির নিমন্ত্রণসভায় উৎসবক্ষেত্রে ধর্মসমাজে এই শুভ্রকোর্তাধারী সৌম্য প্রফুল্লমূর্তি শ্বেতস্য বিদেশীকে এক প্ৰান্তভাগে অনেকবার দেখিয়াছি । আমাদের মধ্যে প্ৰবেশলাভ করিবার জন্য যেন তাহার একটি বিশেষ আগ্রহ ছিল । অনেক সভাস্থলে আমাদের বক্তৃতার ভাষা আমাদের সংগীতের সুর তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত থাকিলেও তিনি প্রতিনিবৃত্ত হইতেন না ; ধৈর্যসহকারে হৃদয়ের অন্তরঙ্গতাগুণে আমাদের ভাবের মধ্যে যেন স্থানলাভ করিতে চেষ্টা করিতেন। পরজাতির গৃঢ় হৃদয়গুহায় প্রবেশ করিবার জন্য যে-নম্রতাগুণের আবশ্যক তাহা তাহার বিশেষরূপে ছিল । ছাত্ৰশিক্ষার যে-কাৰ্যভার তিনি গ্ৰহণ করিয়াছিলেন তাহা পালন করিতে গিয়া তঁহাকে অসামান্য কষ্টস্বীকার করিতে হইত। মধ্যাহ্নের রৌদ্রে অনাহারে অনিয়মে কলিকাতার পথে পথে সমস্তদিন পরিভ্রমণ করিয়াছেন, কিছুতেই তাহার অশ্রান্ত উদ্যমকে পরাভূত করিতে পারে নাই। রৌদ্রতাপ এবং উপবাস তিনি কিরূপ সহ্য করিতে পারিতেন বর্তমান লেখক একদিন তাহার পরিচয় পাইয়াছিল । বোলপুরের শান্তিনিকেতন আশ্রমে উৎসব-উপলক্ষে গত বৎসর পৌষ মাসে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে গিয়া প্ৰাতঃকালে এক পেয়ালা চা খাইয়া তিনি ভ্ৰমণে বাহির হন। বিনা ছাতায় বিনা আহারে সমস্তদিন মাঠে মাঠে ভূতত্ত্ব আলোচনা করিয়া অপরাহুে উৎসবারম্ভকালে ফিরিয়া আসেন— তখন কিছুতেই আহার করিতে সম্মত না হইয়া উৎসবান্তে রাত্রি নয়টার সময় কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া পদব্ৰজে স্টেশনে গমনপূর্বক সেই রাত্রেই কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। একদিন তিনি পদব্ৰজে ভ্ৰমণ করিতে বাহির হইয়া একেবারে বারাকপুরে গিয়া উপস্থিত হন। সেখান হইতে পুনর্বার পদব্রজে ফিরিতে রাত্রি দশটা হইয়া যায়। পাছে ভূত্যদের কষ্ট হয় এইজন্য সেই দীর্ঘ ভ্ৰমণ দীর্ঘ উপবাসের পর অনাহারেই রাত্রি যাপন করেন । কোনো কোনো দিন রাত্রে তিনি আহারে ঔদাসীন্য প্রকাশ করিলে গৃহস্বামিনী যখন খাইতে পীড়াপীড়ি করিতেন, তিনি বলিতেন, ভোজনে আজ আমার অধিকার ও অভিরুচি নাই- দিনের কার্য আজ আমি ভালো করিয়া সম্পন্ন করিতে পারি নাই । প্ৰাতঃকালে আহার করিবার সময় তিনি রুটিখণ্ড গাছের শাখায় এবং ভূতলে রাখিয়া দিতেন, পাখিরা আসিয়া খাইলে পরে তবে তাহার আহার সম্পন্ন হইত। - র্তাহার একটি সাধ ছিল আমাদের দেশীয় শিক্ষিত যুবকদের জন্য ভালো লাইব্রেরি এবং আলোচনাসভা স্থাপন করা। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য রৌদ্রবৃষ্টি অর্থব্যয় এবং শারীরিক কষ্ট তুচ্ছ করিয়া তিনি প্ৰাণপণ চেষ্টা করিয়া ফিরিয়াছেন । র্যাহারা তাহার সহায়তাসাধনে প্ৰতিশ্রুত ছিলেন র্তাহাদের উৎসাহ অনবরত প্ৰজ্বলিত রাখিয়াছেন। অবশেষে আয়োজন সম্পূর্ণ হইতে না হইতেই তিনি সাংঘাতিক পীড়ায় আক্রান্ত হইলেন । । শুনা যায় এই লাইব্রেরি-স্থাপন চেষ্টার জন্য গুরুতর অনিয়ম ও পরিশ্রমই তাহার পীড়ার অন্যতম কারণ। মৃত্যুর পূর্বদিনে তিনি আমাদের দেশীয় কোনো সভ্রান্ত মহিলাকে বলিয়াছিলেন, দেশে আমার যে কোনো আত্মীয়স্বজন নাই তাহা নহে, খৃস্টিয়ান ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করিয়া একেশ্বরবাদ গ্ৰহণ করাতেই