পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ ° の> আমি তঁহাদের পর হইয়াছি। মৃত্যুকাল পর্যন্ত র্তাহার লাইব্রেরির কথা ভুলিতে পারেন নাই। র্তাহার কোনো-একটি ছাত্রের নিকট হইতে তিনি অগ্রিম বেতন লইয়াছিলেন, সেই টাকা তাহাকে ফেরত দিবার জন্য মৃত্যুশয্যায় তাহার বিদেশীয় নাম স্মরণ করিবার অনেক চেষ্টা করিয়া অকৃতকাৰ্য হইয়াছিলেন, সেই তাহার শেষ চেষ্টা ; এবং সেই ছাত্রকে সন্ধান করিয়া তাহার প্রাপ্য টাকা তাহাকে ফিরাইয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন, সেই তাহার শেষ অনুরোধ । তিনি যদি এখানে আসিয়া তাহার স্বজাতীয়দের আতিথ্য লাভ করিতেন তবে আর কিছু না হউক পালন করা কর্তব্য সে-অভিজ্ঞতা তিনি স্বজাতীয়ের নিকট হইতে লাভ করিতে পারিতেন । যদি-বা জীবনরক্ষা না হইত তথাপি অন্তত যেরূপ চিকিৎসা যেরূপ আরাম যেরূপ সেবাশুশ্রুষা তঁহাদের চিরাভ্যস্ত, বিদেশে মৃত্যুকালে সেটুকু হইতে ঠাহাকে বঞ্চিত হইতে হইত না ; এবং যুরোপীয় ডাক্তারের দ্বারা চিকিৎসিত হইবার জন্য অন্তিমকাল পর্যন্ত র্তাহার যে-আকাঙক্ষা অপরিতৃপ্ত ছিল তাহাও পূর্ণ হইতে পারিত । á সুইডেনবাসী হ্যামারগ্রেন সাহেবের বাংলায় আতিথ্যযাপনের সংক্ষেপ বিবরণ আমরা প্ৰকাশ করিলাম । তিনি এ দেশে অল্পকাল ছিলেন, এবং যদিও আমাদের প্রতি র্তাহার আস্তরিক প্রেম ও আমাদের হিতসাধনে তাহার একান্ত চেষ্টা ছিল এবং যদিও তাহার অকৃত্ৰিম অমায়িক স্বভাবে তিনি ছাত্রবৃন্দ ও বন্ধুবর্গের হৃদয় আকর্ষণ করিতে পারিয়াছিলেন, তথাপি এমন-কিছু করিয়া যাইতে পারেন নাই যাহাতে সাধারণের নিকট সুপরিচিত হইতে পারেন, সুতরাং এই বিদেশীর বৃত্তান্ত সাধারণের আলোচ্য বিষয় না হইবার কথা । আমরাও সে প্রসঙ্গে বিরত থাকি,তাম, কিন্তু আমাদের কোনো কোনো বাংলা সংবাদপত্র তাহার অন্ত্যেষ্টিসৎকার সম্বন্ধে যেরূপ নিষ্ঠুর আলোচনা উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে ক্ষোভ প্রকাশ না করিয়া থাকা যায় না । হ্যামারগ্রেন মৃত্যুর পূর্বে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, তাহার মৃতদেহ কবরস্থ না করিয়া যেন দাহ করা হয়। র্তাহার সেই অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে নিমতলার ঘাটে তাহার মৃতদেহ দাহ হইয়াছিল। শাস্ত্ৰমতে অগ্নি যদিও পাবক এবং কাহাকেও ঘূণা করেন না, তথাপি হিন্দুর পবিত্র নিমতলায় স্নেচ্ছদেহ দগ্ধ হয় ইহাতে কোনো কোনো হিন্দুপত্রিকা গাত্ৰদাহ প্ৰকাশ করিতেছেন । বলিতেছেন এ পর্যন্ত মৃত্যুর পরে তাহারা ‘হাড়িডোম প্রভৃতি অনার্য অন্ত্যজ জাতির সহিত একস্থানে ভস্মীভূত হইতে আপত্তি করেন নাই, কিন্তু যে-শ্বাশানে কোনাে সুইডেনবাসীর চিতা জ্বলিয়াছে সেখানে যে র্তাহাদের পবিত্র মৃতদেহ পুড়িবে, ইহাতে র্তাহারা ধৈর্য রক্ষা করিতে পারিতেছেন না । কিছুকাল পূর্বে একসময় ছিল যখন আমাদের স্বদেশপ্রেমিকগণ প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিতেন যে, হিন্দুধর্মে উদারতা বিশ্বপ্ৰেম নির্বিচার-আতিথ্য অন্য-সকল ধর্ম অপেক্ষা অধিক । কিন্তু জানি না। কী দুৰ্দৈবক্রমে সম্প্রতি এমন দুঃসময় পড়িয়াছে যে, আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাও হিন্দুধর্মকে নিষ্ঠুর সংকীর্ণ এবং একান্ত পরবিদ্বেষী বলিয়া স্বীকার করিতে কুষ্ঠিত হইতেছেন না । শ্রুতিতে আছে, অতিথিদেবোভব। কিন্তু কালক্রমে আমাদের লোকাচার এমন অনুদার ও বিকৃত হইয়া আসিয়াছে যে, কোনো বিদেশীয় বিজাতীয় সাধুব্যক্তি যদি আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়া গ্ৰীতিপূর্বক আমাদের মধ্যে অবস্থান করিতে ইচ্ছা করেন, তবে কোনো হিন্দুগৃহ তীহাকে সমাদরের সহিত অসংকোচে স্থান দেয় না, তাহাকে দ্বারস্থ কুকুরের ন্যায় মনে মনে দূরস্থ করিতে ইচ্ছা করে ; এই অমানুষিক মানববৃণাই কি আমাদের পক্ষে অক্ষয় কলঙ্কের কারণ নহে, অবশেষে আমাদের শ্মশানকেও পরদেশীর স্থান নাই, মৃত্যুর পরে আমাদের শ্মশানেও কি পরদেশীর দগ্ধ হইবার অধিকার থাকিবে না। যদি আমাদের ধর্মশাস্ত্ৰে ইহার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধ থাকিত তাহা হইলেও আমাদের ধর্মশাস্ত্রের জন্য লজ্জা অনুভব করিয়া আমরা অগত্যা নীরব থাকিতাম । যখন সেরূপ নিষেধ কিছু নাই তখন ধর্মের নাম করিয়া অধৰ্মবুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিয়া, অকারণে গায়ে পড়িয়া বিদ্বেষবহ্নিকে প্রধূমিত করিয়া