পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՕՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী হিন্দুসমাজের কী হিতসাধন হইবে বলিতে পারি না । শ্মশান বৈরাগ্যের মহাক্ষেত্র। সেখানে মতভেদ ধর্মভেদ জাতিভেদ নাই ; সেখানে একদিন ছোটাে-বড়ো ধনী-দরিদ্র দেশী-বিদেশী, সকলেই মুষ্টিকয়েক ভস্মাবশেষের মধ্যে সমান পরিণাম প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে। আমাদের হিন্দুসন্ন্যাসীরা শ্মশানে সমাজবন্ধনবিহীন মহাকালের নিরঞ্জন নির্বিকার অনন্তস্বরূপ উপলব্ধি করিবার জন্য গমন করিয়া থাকেন । সেখানে সেই দেশকালাতীত ধ্যাননিমগ্ন বৈরাগ্যের সমাধিভূমিতেও কি পরজাতিবিদ্বেষ আপন সংবাদপত্রের ক্ষুদ্র জয়ধ্বজা লইয়া ফাির্ফর শব্দে আস্ফালন করিতে কুষ্ঠিত হইবে না । আমাদের দেবতার মধ্যে যম কোনো জাতিকে ঘূণা করেন না, মহাযোগী মহাদেবেরও সর্বজাতির প্রতি অপক্ষপাতের কথা শুনা যায়। কিন্তু আজ র্তাহাদের লীলাক্ষেত্র বিহারভূমি শ্মশানের প্রান্তদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রহরীগণ মৃতদেহের জাতিবিচার করিতে বসিয়া গিয়াছেন— সে কি ধর্মের গৌরব বৃদ্ধি করিবার জন্য, না সংকীর্ণ হৃদয়ের ক্ষুদ্র বিদ্বেষবুদ্ধি চরিতার্থ করিবার জন্য । এই সুইডেনদেশীয় নিরীহ প্রবাসী গ্ৰীতিপূর্বক বিশ্বাসপূর্বক অতি দূরদেশে পরজাতীয়ের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন ; পাছে কোথাও অনধিকার প্রবেশ হয়, পাছে কাহারও অন্তরে আঘাত লাগে, পাছে অজ্ঞাতসারে কাহারও পীড়ার কারণ হন, এইজন্য সর্বত্র সর্বদাই ত্ৰস্ত সতর্ক বিনম্রভাবে একপাশ্বে অবস্থান করিতেন । সেই দয়ালু সহৃদয় মহাশয় ব্যক্তি কাহারও কোনো অপকার করেন নাই, কেবল পরজাতি পরাধমীর হিতচেষ্টায় আপন জীবনপাত করিয়াছেন মাত্র । সেই অসম্পন্ন চেষ্টার জন্য র্তাহার প্রতি কাহাকেও কৃতজ্ঞ হইতে অনুরোধ করিতেছি না, কিন্তু এই অকালমৃত বিদেশী সাধুর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ নিষ্ঠুর অবমাননা করিতে কি নিষেধ করাও উচিত নহে। যদি দৈবক্রমে কোনো বিদেশী আপনি আত্মীয়স্বজন হইতে বিচ্যুত হইয়া আমাদের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হয়, তবে হউক-না সে পরের সন্তান, হউক-না সে বিধমী, বঙ্গভূমি কি জননীবাৎসল্যে আপন স্নেহাক্রোড়ের এক প্ৰান্তভাগে তাহাকে স্থান দিতে পরিবে না এবং তাহার অকালমত্যুর পরে সকল ঘূণার অবসানক্ষেত্ৰ শ্মশানভূমির মধ্যেও তাহার প্রতি সুকঠোর ঘূণা প্রকাশ করিবে ? এই নিষ্ঠুর বর্বরতা কি অতিথিবৎসল হিন্দুধর্মের প্রকৃতিগত, না। এই পতিত জাতির বুদ্ধিবিকারমাত্ৰ ? এই প্রবাসী যুবক মৃত্যুকালে পবিত্র আর্যভূমির নিকটে কোন অসম্ভব প্রার্থনা করিয়াছিলেন। আমাদের সুপবিত্র সংস্পৰ্শ, না আমাদের সুদূর্লভ আত্মীয়তা ? তিনি ব্ৰাহ্মণের ঘরের আসন, কুলীনের কলিকাতার যে-শষ্মশানে ‘হাড়িডোম” প্রভৃতি অন্ত্যজ জাতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিষিদ্ধ নহে, সেই শ্মশানপ্ৰান্তে ভস্মসাৎ হইবার অধিকার চাহিয়াছিলেন মাত্র । হায় বিদেশী, বঙ্গভূমির প্রতি তোমার কী অন্ধ বিশ্বাস, কী দুঃসহ স্পর্ধা। মনে যত অনুরাগ যত শ্রদ্ধাই থাক পুড়িয়া মরিবার এবং মরিয়া পুড়িবার এই মহাশ্মশানক্ষেত্রে জীবনে মরণে তোমাদের কোনো অধিকার নাই । SVOS ব্যাধি ও প্ৰতিকার ইংরেজিশিক্ষার প্রথম উচ্ছাসে আমাদের বক্ষ যতটা স্ফীত হইয়া উঠিয়াছিল, এখন আর ততটা নাই, এমন-কি, কিছুকাল হইতে নাড়ী স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও যেন দাবিয়া গেছে। জ্বরের মুখে যে-উত্তাপ দেখিতে দেখিতে একশো-চারপাচছয়ের দিকে উঠিতেছিল, এখন যেন তাহা আটানব্বইয়ের নীচে নামিয়া চলিয়াছে এবং সমস্তই যেন হিম হইয়া আসিতেছে। এমন অবস্থায় শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী s ১ পাঠকগণ মনে করবেন না। আমরা ঘূণা প্রকাশ পূর্বক হাড়িডােম প্রভৃতির নামােল্লেখ করিতেছি ; আমরা সংবাদপত্রের ভাষা উদধূত করিতেছি।