পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१०8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মনে করা অসংগত । জাতীয় মহত্ত্বের দুর্গমশিখরে কণ্টকিত পথ দিয়া উঠিতে হয় ; কেমন করিয়া উঠিতে হয়, সে তো আমরা ইংরেজের ইতিহাসেই পড়িয়াছি। আমি এই কথা বলি যে, ইংরেজ যদি আমাদিগকে সমান বলিয়া একাসনে বসাইত, তাহা হইলে আমাদের অসমানতা আরো অধিক হইত। তাহা হইলে ইংরেজের মহত্ত্বের তুলনায় আমাদের গৌরব আরো কমিয়া যাইত। তাহারা পৌরুষের দ্বারা যে আসন পাইয়াছে, আমরা প্রশ্রয়ের দ্বারা তাহা পাইয়া যদি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত থাকি,তাম, আমাদের আত্মাভিমান শান্ত হইত, তবে তদ্দ্বারা আমাদের জাতির গভীরতর দারুণতর দুৰ্গতি হইত। কিছু আদায় করিতে হইবে এই মন্ত্র ছাড়িয়া, কিছু দিতে হইবে কিছু করিতে হইবে, এই মন্ত্র লইবার সময় হইয়াছে। যতক্ষণ আমরা কিছু না দিতে পারিব, ততক্ষণ আমরা কিছু পাইবার চেষ্টা করিলে এবং সে-চেষ্টায় কৃতকার্য হইলেও তাঁহা ভিক্ষাবৃত্তিমাত্ৰ— তাহাতে সুখ নাই, সম্মান নাই। সে কথাটা আমাদের মনের মধ্যে আছে বলিয়াই আমরা ভিক্ষার সময় কৰ্ণ ভীষ্ম দ্রোণ গীেতম কপিলের কথা পাড়িয়া থাকি । বলি যে, আমাদের পিতামহ জগতের সভ্যতার অনেক খোরাক জোগাইয়াছিলেন ; অতএব ভিক্ষা দে বাবা ! পিতামহদের মহিমা স্মরণ করার খুবই দরকার কিন্তু সে কেবল নিজেকে মহিমালাভে উত্তেজিত । করিবার জন্য, ভিক্ষার দাবিকে উচ্চ সপ্তকে চড়াইবার জন্য নহে। কিন্তু যে-ব্যক্তি হতভাগা, তাহার সকলই বিপরীত । যাহাই হােক, পৃথিবীতে আমাদের একটা-কিছু উপযোগিতা দেখাইতে হইবে। দরখাস্ত লিখিবার উপযোগিতা নহে, দরখাস্ত পাইবার । কিছু-একটার জন্য পৃথিবীকে আমাদের দেউড়িতে উমেদারি করিতে হইবে, তবে আমাদের মুখে আস্ফালন শোভা পাইবে । রাষ্ট্রনীতিতে মহত্ত্বলাভ আমাদের পক্ষে সর্বপ্রকারে অসম্ভব । সেই পথে আমাদের সমস্ত মনকে যদি রাখি, তবে পথের ভিক্ষুক হইয়াই আমাদের চিরটা-কাল কাটিবে। যে-শক্তির দ্বারা রাষ্ট্রীয় গৌরবের অধিকারী হওয়া যায় সে-শক্তি আমাদের নাই, লাভ করিবার কোনো আশাও দেখি না । কেবল ইংরেজকে অনুরোধ করিতেছি, তিনি যে-শাখায় দাড়াইয়া আছেন, সেই শাখাটাকে অনুগ্রহপূর্বক ছেদন করিতে থাকুন। সেই অনুরোধ ইংরেজ যেদিন পালন করিবে, সেদিনের জন্য অপেক্ষা করিতে হইলে কালবিলম্ব হইবার আশঙ্কা আছে । যেখানে আমাদের অধিকার নাই, সেখানে কখনো কপট করজোড়ে কখনো কপট সিংহনাদে ধাবমান হওয়া বিড়ম্বনা, সে কথা আমরা ক্ৰমেই অনুভব করিতেছি । বুঝিতেছি, নিজের চেষ্টার দ্বারা যে-জিনিসটা এ বৎসর একজন কৃপা করিয়া দিবে, পাঁচ বৎসর বাদে আর-একজন গালে চড় মারিয়া কড়িয়া লইবে, সেটা যতবড়ো জিনিস হােক, আমাদিগকে এক ইঞ্চিও বড়ো করিতে পরিবে না । কোনো বিষয়ে একটা-কিছু করিয়া তুলিতে যদি চাই। তবে উজান স্রোতে সীতার দিয়া তাহা পারিব না । কোথায় আমাদের বল, আমাদের প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি কোন দিকে, তাহা বাহির করিতে হইবে । তাহা বাহির করিতে হইলেই নিজেকে যথার্থরাপে চিনিয়া লইতে হইবে । হতাশ ব্যক্তিরা বলেন, চিনিব কেমন করিয়া । বিদেশী শিক্ষায় আমাদের চোখে ধূলা দিতেছে। ধুলা নহে, তাহা অঞ্জন । বিপরীত সংঘাত ব্যতীত মহত্ত্বশিক্ষা জ্বলিয়া উঠে না । খৃস্টধর্ম যুরোপীয় প্রকৃতির বিপরীত শক্তি । সেই শক্তির দ্বারা মথিত হইয়াই য়ুরোপীয় প্রকৃতির সারভাগ এমন করিয়া দানা বাধিয়া উঠিয়াছে । তেমনই য়ুরোপীয় শিক্ষণ ভারতবষীয় প্রকৃতির পক্ষে বিপরীত শক্তি। এই শক্তির দ্বারাই আপনাকে যথার্থীরাপে উপলব্ধি করিব এবং ফুটাইয়া তুলিব । ) আমাদের শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা গিয়াছে। অন্তত নিজেকে আদ্যোপান্তভাবে জানিবার জন্য আমাদের একটা ব্যাকুলতা জন্মিয়াছে। প্রথম আবেগে অনেকটা হাতড়াইতে হয়,