পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8\Ն রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রাচীন শব্দাচাৰ্যগণও নি উপসর্গের অন্তর্ভাব স্বীকার করিয়াছেন, যথা, মেদিনীকোষে নি অর্থে “মোক্ষঃ, অন্তর্ভাবং বন্ধনম” ইত্যাদি কথিত হইয়াছে। কিন্তু পাছে সেই অর্থ স্বীকার করিলে কোনো অংশে প্ৰবন্ধকারের সহিত ঐক্য সংঘটন হয়, এইজন্য যত্নপূর্বক তাহা পরিহার করিয়াছেন ; ইহা নিশ্চয় একটা প্রবৃত্তি অর্থাৎ প্রকৃষ্টাবৃত্তির কার্য। নি উপসর্গ অর্থে নিতরাং কেন হইল। বস্তুত নি, প্র, পরি, উৎ প্রভৃতি অনেক উপসর্গেরই আধিক্য অর্থ দেখা যায়। ইহার কারণ, আধিক্যের নানা দিক আছে। কোনোটা বা বাহিরে বহুদূর যায়, কোনোটা ভিতরে, কোনোটা পার্থে, কোনোটা উপরে । অত্যন্ত পণ্ডিত্যকে এমনভাবে দেখা যাইতে পারে যে, তাহা পণ্ডিতমহাশয়ের মনের খুব ভিতরে তলাইয়া গিয়াছে, অথবা তাহা সকল পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের । অগ্ৰে অৰ্থাৎ সম্মুখে চলিয়া গিয়াছে, অথবা তাহারাশীকৃত হইয়া পর্বতের ন্যায় উপরে চড়িয়া গিয়াছে, অথবা তাহা নানা বিষয়কে অবলম্বন করিয়া চতুদিকে পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। কালক্রমে এই সকল সূক্ষ্ম প্রভেদ ঘুচিয়া গিয়া সর্বপ্রকার আধিক্যকেই উক্ত যে-কোনো উপসর্গ দ্বারা যাদৃচ্ছিাক্রমে ব্যক্ত করা প্রচলিত হইয়াছে। যদিচ উৎ উপসর্গের উধ্বগামিতার ভাব সুস্পষ্ট, এবং উৎপত্তি অনুসারে ‘উদার’ শব্দে বিশেষরূপে উচ্চতা ও উন্নতভােবই প্ৰকাশ করে, তথাপি জয়দেব রাধিকার পদ পল্লবে উদার বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া তাহার একান্ত গৌরব সূচনা করিয়াছেন মাত্র । অতএব নানা উপসর্গে যে একই ভূশার্থ পাওয়া যায়। তন্দ্বারা সেই উপসর্গগুলির ভিন্ন ভিন্ন নানা মূল অর্থেরই সমর্থন করে। অনেক স্থলেই শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের সময় উক্ত উপসর্গগুলির মূল অর্থ অথবা ভূশার্থ দু-ই ব্যবহার করা যাইতে পারে। যথা, নিগুঢ় অর্থে অত্যন্ত গুঢ় অথবা ভিতরের দিকে গৃঢ় দু-ই বলা যায়, intense অত্যন্তরূপে টানা অথবা ভিতরের দিকে টানা, উন্মত্ত অত্যন্ত মত্ত অথবা উদ্ধৰ্বদিকে মত্ত অর্থাৎ মত্ততা ছাপাইয়া উঠিতেছে, concentrate অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত অথবা এরূপ স্থলে কেহ যদি বলেন, অত্যন্ত একত্রে কেন্দ্রীভুত। অর্থের বিকল্পে অন্য অর্থ আমি স্বীকার করিব না, তবে তাহার সহিত বৃথা বিতণ্ডা করিতে ক্ষান্ত থাকিব । সমালোচক মহাশয় ইহাও আলোচনা করিয়া দেখিবেন, প্রতি অনুআং প্রভৃতি উপসর্গে নিতরাং প্রকৃষ্ট সম্যক প্রভৃতি ভূশাৰ্থ বুঝায় না, তাহার মুখ্য কারণ ঐ-সকল উপসর্গে দূরত্ব বুঝাইতে পারে না । ፪ বাহা হউক, সংস্কৃত ভাষার উপসর্গের সহিত য়ুরোপীয় আর্যভাষার উপসর্গগুলির যে আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে এবং উভয়ের উৎপত্তিস্থল যে একই, সমালোচক মহাশয় বোধ করি তাহা অস্বীকার করেন না । • সংস্কৃত উপসর্গগুলির প্রচলিত নানা অর্থের মধ্যে যে-অর্থ ভারতীয় এবং যুরোপীয় উভয় ভাষাতেই বিদ্যমান, তাহাকেই মূল অর্থ বলিয়া অনুমান করা অন্যায় নহে। এইরূপ আর্যভাষার নানা শাখার আলোচনা করিয়া উপসর্গের মূলে উপনীত হইতে যে-পাণ্ডি অবকাশ এবং প্রামাণিক গ্ৰস্থাদির সহায়তা আবশ্যক, আমার তাহা কিছুই নাই। র্যাহাদের সেই ক্ষমতা ও সুযোগ আছে, এ সম্বন্ধে তাহাদের মনোযোগ আকর্ষণ ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই সম্ভবে না । স্বল্প প্রমাণ ও বহুল অনুমান আশ্রয় করিয়া কয়েকটি কথা বলিব, তাহা অসম্পূর্ণ হইলেও তদ্দ্বারা যোগ্যতার লোকের মনে উদ্যম সঞ্চার করিয়া দিতে পারে, এই আশা করিয়া লিখিতে স্পধিত হইতেছি । প্ৰ উপসর্গের অর্থ একটা কিছু হইতে বহির্ভাগে অগ্ৰগামিতা । যুরোপীয় উপসর্গ হইতেও ইহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাভাষায় আইসা এবং পইসা নামক দুইটি ক্রিয়া আছে, তাহা আবিশ এবং প্ৰবিশ ধাতুমূলক- তন্মধ্যে পইসা ধাতু পশিল প্রভৃতি শব্দে বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে ও কাব্যে স্থান পাইয়াছে এবং আইসা ধাতু এখনো আপন অধিকার বজায় রাখিয়াছে। আইস এবং পইসা এই দুটি ধাতুতে আ এবং প্র উপসর্গের অর্থভেদ স্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে। ইহা কেবল দিকভেদ, পইসা বক্তার দিক হইতে অগ্রভাগে এবং আইসা বক্তার দিকের সান্নিধ্যে আগমন সূচনা করে। যুরোপীয় আর্যভাষার pro উপসর্গের মুখ্য অর্থ বহিদিকে অগ্ৰগামিতা এ কথা সর্ববাদিসম্মত ; অতএব এই অর্থ যে মূল প্রাচীন অর্থ, তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। r এ কথা স্বীকার্য যে, সূর্যের বর্ণরশ্মির ন্যায় প্র উপসর্গ যুরোপীয় ভাষায় নানা উপসর্গে বিভক্ত